আমরা লাইভে English শুক্রবার, মার্চ ২৪, ২০২৩

কাশ্মিরে ফাঁকা বিছানাই বলে দেয় একটি জীবন হারিয়ে গেছে

জাকির মুসার জানাজায় মানুষের ঢল

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা শ্রীনগরের পুরনো শহরে। এখানে প্রায়ই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী আর কাশ্মিরি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সঙ্ঘাত হতে দেখতাম।

এসব বিক্ষোভের ছবি তুলতে যেসব ফটোগ্রাফার আসত, তারা সবাই সবসময়ই হতো ছেলে।

তাদের দেখলেই নিজেকে তাদের মতো কল্পনা করতাম। মনে হতো, ছবি আমিই তুলছি।

কাশ্মিরে ১৯৯০-এর দশকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এরপরের রক্তপাত ও অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ফটো সাংবাদিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গত তিন দশকে কাশ্মিরে ভারত সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে সবচেয়ে জোরালো প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সাংবাদিকতা। কাশ্মিরি সাংবাদিকেরা ঘটনাপ্রবাহকে প্রাণবন্ত রাখতে বিরামহীনভাবে কাজ করেছেন।

তবে ফটোসাংবাদিকতা পেশা হিসেবে বেছে নেয়াটা সহজ কাজ ছিল না।

আমি বেড়ে ওঠেছিলাম এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। আমার বাবা ছিলেন ট্রাকচালক। আমার মা ছিলেন গৃহিনী। আমার মা-বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি নিয়ে সরকারি কোনো চাকরিতে প্রবেশ করি। তবে আমি তাদের ইচ্ছা গুঁড়িয়ে দিয়ে সাংবাদিকতার স্কুলে ভর্তি হই।

চার বছর পর আমি যখন ফটো সাংবাদিক হলাম, তখন আমার মা-বাবা আমাকে সমর্থন করতে লাগলেন।

অবশ্য কাশ্মিরে এখনো নারীদের জন্য সাংবাদিকতা গ্রহণযোগ্য পেশা নয়। এখানকার সমাজ আশা করে, আমরা যেন বাড়িতেই থাকি বা অফিস-আদালতে কাজ করি।

কাশ্মিরি নারীদের চোখে কাশ্মির

নারী সাংবাদিকতা অনেক সময় হতাশাজনক ক্ষেত্র মনে হতে পারে। লোকজন ক্যামেরা হাতে কোনো নারীকে দেখতে অভ্যস্ত না হওয়ায় আমার দিকে পিটপিট করে তাকায়।

একবার সামাজিক মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছিলাম। বন্দুকযুদ্ধের একটি ঘটনা আমাকে কভার করতে দেখে আমাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুকবির (চর) হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছিল। তারা আগে কখনো কোনো নারীকে এমন ছবি তুলতে না দেখায় তারা বিষয়টি বুঝতে পারছিল না।

আরো অনেক ঝুঁকি ছিল। সঙ্ঘাতের ঝুঁকি ছাড়াও সাংবাদিকেরা প্রহার, ভীতি প্রদর্শন ও আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কায় থাকত।

তবে নারীদের দৃষ্টিতে পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা আমি করেছি এবং তা অব্যাহতভাবেই করে যাচ্ছি।

কাশ্মিরে নারীদের অবস্থা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। তাদের ক্ষয়ক্ষতি, তাদের উদ্যোম কোনো কিছুই স্থান পায় না।

আমি তাদের না-বলা কাহিনীই তুলে ধরতে চাই। আমি জানি, আমার প্রতিবেশী নারীরা কথা বলতে চায়। তারা কষ্টে আছে, কিন্তু তবুও তাদের চেহারা ঢেকে রাখতে হয়, তারা পুরুষ সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুলতে অস্বস্তি বোধ করে।

বিদ্রোহীর জানাজা

গত বছরের কথাই ধরা যাক। আমি ছবি তুললাম প্রিয়জন হারানোর পরও নীরব থাকা নারীদের।

২০১৯ সালের ২৪ মে সকালে প্রখ্যাত বিদ্রোহী কমান্ডার জাকির মুসার জানাজার নামাজের ছবি তুলতে গেলাম অন্য সাংবাদিকদের সাথে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এই ছাত্র অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। তিনি ছিলেন নতুন প্রজন্মের বিদ্রোহীদের জনপ্রিয় মুখ। তিনি আনসার গাজওয়াতুল হিন্দের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই গ্রুপটি আল-কায়েদার সাথে যুক্ত ছিল।

আমাকে নুরপুরা গ্রামে যেতে হয়েছিল। মোটরবাইকে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় অপর এক সাংবাদিক আমাকে রাইড দিলেন।

নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক পাহারা কাটিয়ে আমরা অবশেষে ওই স্থানে গেলাম। আমাকে দেখে অনেকেই নানা প্রশ্ন তুলতে লাগল। কিন্তু তাদের কথা আমাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।

ফাঁকা বিছানা

আমি আরেকটি চেষ্টা করলাম। মুসার লাশ যখন জানাজার জন্য ময়দানে গেল, আমি তখন দূর থেকে শট নিলাম। স্লোগানের দৃশ্যও ওঠে এলো আমার ক্যামেরায়। ছবি তোলার কাজ যখন শেষ করে যখন ক্যামেরা গোটানোর চেষ্টা করছি, তখন দেখলাম, যেখানে মুসাকে শোয়ানো হবে, সেই স্থানটি দেখা যাচ্ছে। আমি ছবি নিলাম। কবরটি তখনো ফাঁকা ছিল।

আমার কাছে এই ফাঁকা কবরের আরেকটি তাৎপর্য ছিল। এখানে যাকে শোয়ানো হবে, তিনি প্রিয়জনদের ছেড়ে যাচ্ছেন, পরিবারের মায়া ত্যাগ করেছেন। প্রতিনিয়ত যারা নিহত হচ্ছেন, তারাই এই ফাঁকা স্থান পূরণ করেন।

হারানো জীবন

আমি মনে করি, আমার সব ছবিই আমার দেশের দৈনন্দিন ছবি প্রকাশ করছে। এখানকার প্রতিটি ছবিই সুন্দর হিমালয়ের চিত্রের চেয়েও ভালো। তবে এসব ছবি কাশ্মির ট্রাজেডির কথা বলে। কাশ্মিরে হাজার হাজার লোক মারা গেছে। তাদের বেশির ভাগই বেসামরিক লোক।

এসব ছবি ২০১৭ সালের আগস্টে আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাকে পুলওয়ামায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত দিনমজুর ফিরদাউস আহমদ খানের পরিবারের সাথে সাক্ষাত করতে পাঠানো হলো। আমার ভয় ছিল, পরিবারটির সদস্যরা হয়তো আমার সাথে কথা বলবে না, বা নিরাপত্তা বাহিনী আমাকে আটকিয়ে দেবে। আমি হয়তো তাদের কথা বলতে পারব না বলেও ভয় ছিল।

কিন্তু আমি ফিরদাউসের বিধবা স্ত্রী রুকসানার সাথে সাক্ষাত করতে সক্ষম হলাম। তার বয়স তখন ছিল ২৫ বছর। অল্প সময়ের মধ্যেই তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হওয়ার কথা। রোকসানা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন। আমাকে তার স্বামী হারানোর যন্ত্রণার কথা বলতে থাকলেন। তার ভেতরে চাপা ছিল যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা কেবল অপর এক নারীর সামনেই প্রকাশ করা যায়।

তার কাহিনী অত্যন্ত করুণ হলেও আমার মনে হলো, তা প্রকাশ করা দরকার ছিল। রুকসানার দুই বছরের মেয়ে তার বাবার কফিন ধরে তাতে চুমু খেয়েছিল। তারপর চলে যাওয়ার আগে তার মুখটি স্পর্শ করেছিল। কফিনটি বাড়ি ত্যাগ করল, লাশটি খালি করে সেটি চলে যাবে হাসপাতালে।