ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য যে অর্থ বহন করে বাইডেনের জয় ও ট্রাম্পের পরাজয়

অদ্ভুত একটা নির্বাচন – যেটাকে সবচেয়ে ভালো আবার সবচেয়ে খারাপ বলা যায় – সেই নির্বাচনে জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে পপুলার ও ইলেক্টরাল ভোট দুটোই বেশি পেয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। এখনও এটাকে আসলে চূড়ান্ত বিজয় বলা যাচ্ছে না, কারণ ট্রাম্প এখনও এটার স্বীকৃতি দেননি এবং আদালতে লড়াইয়ের হুমকি দিয়েছেন তিনি। খুব কম ব্যক্তিই ট্রাম্পের সুযোগ দেখছেন এখানে। অধিকাংশ মানুষই যেখানে মনে করছেন যে, ট্রাম্পের যুগ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো যে জঞ্জাল তিনি তৈরি করে গেছেন, সেটাও আরও কিছুকাল ঝুলে থাকবে।
ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা যদি ভালো চর্চা হয়ে থাকে, নির্বাচন পরবর্তী বিশৃঙ্খলা মোটেই ভালো কিছু নয়। ভোট গণনার হিসেবে বাইডেন জিতেছেন, কিন্তু ট্রাম্পও খুব একটা পিছিয়ে নেই। অনেকেই এই বাস্তবতাটা অস্বীকার করছেন। ট্রাম্প প্রায় ৫০% ভোট পেয়েছেন। বাইডেনও সেটাই পেয়েছেন। পপুলার ভোটে দুজনার ব্যবধান সর্বোচ্চ ২%। এটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে জনগণের প্রতিক্রিয়ার জায়গায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি মানুষ ভোট দিয়েছে, এবং সে কারণে এই লড়াইটা বিশেষ অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর অর্থ হলো ডেমোক্র্যাটরা এবার আরও বেশি ভোট দিতে গেছে যাতে হিলারি ক্লিন্টনের মতো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না হয়। হিলারি প্রতিপক্ষের চেয়ে কিছু ভোট বেশিই পেয়েছিলেন কিন্তু ইলেক্টরাল কলেজে হেরে গিয়েছিলেন। বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল আদালতে। এ কারণে নির্বাচনী গণতন্ত্রের অনেক ‘অগণতান্ত্রিক’ বিষয় আরও গভীর দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
মার্কিন নির্বাচন ও দক্ষিণ এশিয়া
বিশেষ করে ভারতে মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিল, কারণ কমলা হ্যারিস হলেন বাইডেনের রানিং মেট। তার মা ছিলেন ভারতীয় এবং বাবা ছিলেন ক্যারিবিয়ান। ভারতীয়রা তাই তাকে নিজেদের একজন মনে করছে। ভারতীয় মিডিয়া তাকে প্রচুর কাভারেজ দিয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের আমলে ভারত বড় ধরনের সুবিধাভোগী ছিল, যদিও সাকুল্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেটা তারা পেয়েছে, সেটা হলো কৌশলগত সম্পদ। এবং চীনের সাথে সম্পর্কিত সুবিধাদি পেয়েছে। ট্রাম্পের অতিকথন ভারতের রাস্তাঘাটের আবেগের সাথে মিলে গেছে, যেটাকে বিজেপি চীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করেছে। ‘আমেরিকা প্রথম’ শ্লোগান বিজেপির ‘ভারত প্রথম’ শ্লোগানের খুবই কাছাকাছি।
এই অঞ্চলের জন্য বা ভারতের অভ্যন্তরেও শ্লোগানটা খুব একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। এই বিশ্বাস আর শ্লোগানের একটা স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হলো ‘হিন্দু প্রথম’ নীতি। আত্মার দিক থেকে, ভারত আর ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র কাছাকাছি ছিল কিন্তু সেই যুগের অবসান ঘটেছে। ভারতকে এখন একটা নতুন বিশ্বের দিকে তাকাতে হবে, যেখানে কেউ প্রথম নয় – অন্তত সেই শ্লোগানটা নেই।
বাইডেন সেই ধরনের অত্যুৎসাহী প্রেসিডেন্টও নন, যিনি আগ্রহ নিয়ে গণতন্ত্র কার্ড খেলবেন। এর অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র সঙ্ঘাত নিরসনের দিকে অনেক বেশি মনোযোগ দেবে এবং খুব কড়া ধরনের পাকিস্তান-বিরোধী হবে না, যেটা ভারতের অনেকে আশা করছে।
বাহিরে, ভেতরে
ট্রাম্প পুরোপুরি ভারতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর অনেকেই চীনের বিরুদ্ধে সামরিক সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রে ভারতের উপর ভরসা করেছিলেন। বাইডেন এ ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হবেন। অভ্যন্তরীণ ব্যপারেও তিনি হয়তো খোলামেলা ভারতপন্থী হবেন না। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো শান্তি আলোচনার জন্য চাপ দিতে পারেন, যদিও সেই সম্ভাবনাটা খুবই কম। আর, আগের মতোই, মার্কিন স্বার্থ সবসময় ভারতের স্বার্থের আগে থাকবে, যে বাস্তবতাটা ভারতীয় মিডিয়ার কিছু অংশ সবসময় বুঝতে পারে না।
বাইডেনের অবস্থান ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে। জি নিউজ বলেছে, বাইডেন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএস) ও ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্সের (এনআরসি) ব্যাপারে তার অসমর্থনের কথা জানিয়েছেন এবং ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ব্যাপারে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত কমলা হ্যারিসের বক্তব্যও ভারত ভুলতে পারবে না।
তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মীরীদেরকে আমাদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, বিশ্বে তারা একা নয়। পরিস্থিতির উপর আমরা নজর রাখছি। পরিস্থিতি দাবি করলে সেখানে হস্তক্ষেপের দরকার হতে পারে”।
এগুলো নির্বাচনের আগের কথা, তাই, অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি কাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্টরা এগুলো ভুলে যাবে না। এর অর্থ হলো প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়া না হলেও ভারতের উপর কূটনৈতিক চাপ বাড়বে। অতিমাত্রায় প্রশ্রয়দাতা ট্রাম্পের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার বলয়ে ভারতকে হয়তো আরও ছাড় দেয়া লাগতে পারে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র - উভয় নীতিই যদি নজরদারিতে থাকে, তাহলে সেটা ভারতের আগ্রাসী মানসিকতার ব্যক্তিদের জন্য অস্বস্তির কারণ হবে। ট্রাম্প-মোদি সমীকরণ এখন খানিকটা খারাপ আবহাওয়ায় পড়ে গেছে। বাইডেন সুযোগ পেলে চীনের সাথেও বাণিজ্য চুক্তিতে যাবেন। অন্তত তিনি কম শত্রুতা দেখাবেন এবং ভারতের জন্য সেটা পরিস্থিতি আরও কঠিন করে দিতে পারে।
বাকি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এটা আসলে কোন বিবেচ্য নয় কারণ তারা শুধু একটি ইস্যুতেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লেনদেন করে, সেটা হলো অভিবাসন। বাইডেন এরই মধ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, অবৈধ অভিবাসীদেরকে তিনি নাগরিকত্ব দিবেন, তাই দক্ষিণ এশিয়ায় যু্ক্তরাষ্ট্রের জন্য সমর্থনটা নিশ্চিত হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতের উপর আরও কিছুটা চাপ দিতে পারে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখনকার চেয়েও হয়তো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারবে।