আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, জুন ০৬, ২০২৩

যুক্তরাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য ‘শত্রু’ প্রয়োজন: প্রফেসর চেং

Screenshot 2020-10-14 065736
প্রফেসর চেং শিঝোং

সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাণ্ড ল’-এর অধ্যাপক, চীনের অন্যতম দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ প্রফেসর চেং শিঝোংয়ের সাথে বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছে সাউথ এশিয়ান মনিটর। প্রফেসর চেং বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্ক, এ অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক, বাণিজ্য ও সঙ্ঘাত মিলিয়ে ইন্দো-চীন সম্পর্ক, উন্নয়ন এবং দক্ষিণ এশিয়া ও বিআরআইসহ বেশ কিছু ইস্যুতে কথা বলেন। 

সাউথ এশিয়ান মনিটর’র পক্ষ থেকে অতিথির সাথে কথা বলেছেন আফসান চৌধুরী। 

সাউথ এশিয়ান মনিটর (এসএএম): চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, সেটার কারণ কি বাণিজ্য না কি দক্ষিণ চীন সাগরে উপস্থিতি?

প্রফেসর চেং শিঝোং: যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তারা অব্যাহতভাবে যুদ্ধ জাহাজ আর বিমান পাঠাচ্ছে। তারা চীন-ভারত সম্পর্কে এবং চীন আর আসিয়ান দেশগুলোর সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে। তারা সম্ভাব্য সবগুলো ক্ষেত্রেই চীনের বিরুদ্ধে সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, এবং এভাবেই চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ফেলে রেখেছে।

আমার মতে, এই সমস্যাগুলোর প্রধান কারণ হলো চীনের উত্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ভয়। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হলো তারা চীনের শান্তিপূর্ণ উত্থান ও উদীয়মান বাজার অর্থনীতিতে চীনের শক্তি বেড়ে যাওয়ায় সেটা তাদের শতাব্দি পুরনো আধিপত্যের জন্য ‘হুমকি’ সৃষ্টি করেছে। সেটা হলে যুক্তরাষ্ট্র আর বিশ্ব ব্যবস্থার উপর কর্তৃত্ব করতে পারবে না। 

বিশ্বের বহু-মেরুকরণ, অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র একটা অদম্য ঐতিহাসিক ধারা হয়ে উঠেছে। এটাকে কোন ব্যক্তি বা কোন শক্তি থামাতে পারবে না। ইতিহাসের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি করে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। 

বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে খাটো করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব থেকে, প্যারিস চুক্তি থেকে, ইউনেসকো, ইরান পারমাণবিক চুক্তি, ইউএনএইচআরসি, এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশান, ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন, এবং সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নীতি সারা বিশ্বেই ক্রমাগত অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে। 

এই সবগুলো মিলিয়েই বর্তমান চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনাটা তৈরি হয়েছে। 

এসএএম: এটা কি নতুন ‘শীতল যুদ্ধ’, যেটা মিডিয়া বলছে? শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক নিশ্চিত করতে উভয়েই কি করতে পারে?

প্রফেসর চেং: আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের ২০০ বছরের ইতিহাস দেখি, তাহলে আমরা জানতে পারবো যে এই দেশটি ‘শত্রু’ ছাড়া এবং যুদ্ধ ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। সামরিক যুদ্ধ, আর্থিক যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুদ্ধ, এবং আরও বিভিন্ন উপায়ে, আর্থিক সঙ্কট সৃষ্টি করে বিশ্বের সম্পদকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে, এবং এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠেছে। 

কিছু মিডিয়া এবং স্কলার বলেছে যে, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একটা ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করেছে। আমি বিশ্বাস করি যে, চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার বর্তমান উত্তেজনাটা যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করেই সৃষ্টি করেছে। কৃত্রিমভাবে তথাকথিত ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ সৃষ্টির বিষয়টিকে প্রবলভাবে বিরোধিতা করে চীন, যেটা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মৌলিক স্বার্থকে পুরোপুরি লঙ্ঘন করে। বিশ্বের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা থেকে এটা পুরোপুরি একটা বিচ্যুতি। 

চীন আশা করে, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে। একই সাথে, এখানে যে সব অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সেগুলো মোকাবেলার জন্যও চীন পুরোপুরি প্রস্তুত। চীন আর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটো অর্থনীতি, এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ধারাটা পুরো বিশ্বের উপরই প্রভাব ফেলে। 

আমরা এটা বলতে পারি যে, চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য চীন তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু একই সাথে আবার এই চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কটাকে ধ্বংস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

চীন একটি শান্তিকামী দেশ এবং অন্য কোন দেশের উপর কখনও তারা হামলা করেনি। কিন্তু বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি রয়েছে চীনা জনগণের। চীন যুদ্ধের বিরোধিতা করে কিন্তু যুদ্ধ করতে তারা ভয় পায় না। যুক্তরাষ্ট্র একটা দুর্বৃত্ত দেশ হয়ে উঠেছে এবং যে কোন ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে তারা ইচ্ছুক। যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে, চীনের সশস্ত্র বাহিনী তাহলে নিশ্চিতভাবে প্রবল শক্তি নিয়ে পাল্টা আঘাত করবে। 

এসএএম: ভবিষ্যতে ভারত আর চীনের মধ্যে সীমান্ত সঙ্ঘাত ঠেকানোর জন্য দ্বিপাক্ষিকভাবে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?

প্রফেসর চেং: চীন-ভারত সীমান্তের পশ্চিমাংশে সামরিক অচলাবস্থা চার মাসের বেশি স্থায়ী হয়েছে। ভারতীয় সেনারা বারবার সীমান্ত অতিক্রম করে চীনা ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা করার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। 

সম্প্রতি চীন আর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। একই সাথে এই পরিস্থিতির সমাধান খুঁজতে ভারত আর চীন সামরিক ও কূটনৈতিক পর্যায়েও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে বোঝা যায় যে, কোন পক্ষই চায় না যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক, এবং এভাবেই বিষয়টা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের স্বাভাবিক ধারার উপর প্রভাব ফেলছে। 

২১ সেপ্টেম্বর কর্পস কমান্ডার পর্যায়ে ষষ্ঠ দফা আলোচনা হয়েছে। দুই দেশই লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) এলাকায় স্থিতিশীলতা আনতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে খোলামেলা ও গভীর বিনিময় করেছে। দুই দেশের নেতারা যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়েছেন, সেগুলো সততার সাথে বাস্তবায়নের ব্যাপারে তারা সম্মত হয়েছেন। 

এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগ ও সমন্বয় শক্তিশালী করা, ভুল বোঝাবুঝি এবং ভুল ধারণা এড়ানো, ফ্রন্টলাইনে সেনা সংখ্যা বাড়ানো থেকে বিরত থাকা, স্থানীয় পরিস্থিতিকে একতরফাভাবে পরিবর্তনের চেষ্টা না করা, এবং পরিস্থিতি জটিল করতে পারে, এ ধরনের কোন পদক্ষেপ না নেয়া। 

যত দ্রুত সম্ভব সপ্তম দফা কর্পস কমান্ডার পর্যায়ের আলোচনায় বসা, স্থানীয় সমস্যা সমাধানে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া, এবং সীমান্ত এলাকাকে যৌথভাবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ব্যাপারেও দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে। 

এই মুহূর্তে, প্রধান সমস্যা হলো ভারত তাদের ‘সামনে এগুলোর পরিকল্পনা’ ত্যাগ করছে না এবং সীমান্ত এলাকাতে তাদের সামরিক মোতায়েন এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি আরও বাড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভারত একটা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে, যেটা পেলেই তারা চীনা ভূখণ্ডে তাদের ‘লাদাখ ইউনিয়ন টেরিটরি’ স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা জারি রাখবে। 

ভূখণ্ডগত ইস্যুতে চীনের অবস্থান খুবই দৃঢ়: চীন এক ইঞ্চি ভূখণ্ডও হারাবে না, এবং চীনের পিপলস লিবারেশান আর্মি জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে পুরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সক্ষম এবং আত্মবিশ্বাসী। 

এসএএম: সীমান্ত সঙ্ঘাতের পর চীন আর ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কের উপর কি এর প্রভাব পড়েছে? চীন কি ভারতের পদক্ষেপের জবাব দেবে?

প্রফেসর চেং: ভারত প্রায়ই বুঝতে পারে না যে, কোনটা তার ও অন্যদের জন্য ভালো, আর কোনটা খারাপ। অন্যদের সমস্যা থেকে সুযোগ নিতে পছন্দ করে তারা। ভারতের বহু দশকের একজন বন্ধু হিসেবে, আমি তাদের ব্যাপারে প্রায়ই উদ্বিগ্ন হই এবং তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে লজ্জিত হই। 

যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের উপর জোরেশোরে চাপ দিচ্ছে। সে কারণে ভারত ভাবছে যে, একটা সুযোগ সামনে এসেছে। এবং তারা সীমান্ত এলাকাতে তৎপরতা চালিয়ে চীনা ভূখণ্ডের দখল নিতে চেয়েছে। সেখানে ব্যর্থতার পর, তারা যখন দেখেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়ার দাবি করেছে, ভারত তাৎক্ষণিকভাবে তাদের অনুসরণ করে চীনের উপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বেশ কতগুলো ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিয়েছে। 

চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এবং চীনা অর্থনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার জন্য ভারত বেশ কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই সব পদক্ষেপের খুব সামান্যই প্রভাব পড়েছে চীনের উপর। শেষ বিচারে, ভারতই এখানে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম মেয়াদে ভারতের অর্থনীতির গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭% অতিক্রম করেছিল। এক দৃষ্টিতে দেখলে মোদির বাজার উন্মুক্ত করার নীতি, ভারতে চীনের দীর্ঘমেয়াদি দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রভাব, এবং ভারতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় ধরনের বিনিয়োগের কারণে এই অর্জনটা হয়েছিল। 

এখন ভারত তাদের বাজারে চীনা পুঁজি এবং প্রযুক্তির প্রবেশ বন্ধ করার চেষ্টা করছে, যেটার ফল হবে উল্টা। সেই সাথে করোনাভাইরাস মহামারিও ভারতে দিন দিন আরও মারাত্মক হয়ে উঠছে। ফলে, তাদের জিডিপি বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ২৩.৯% পড়ে গেছে এবং তাদের অর্থনীতি পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। 

ভারতের সাথে চীনের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতে চীনের রফতানি ৭৪.৮৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ভারত থেকে চীনের আমদানি হয়েছে ১৭.৯৮ বিলিয়ন ডলার। ভারতের সাথে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৫৬.৮৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতে ১৯০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং ভারত চীনে ২৫.৬৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ভারতের চেয়ে চীনের বিনিয়োগ প্রায় সাত গুণ বেশি। 

সে কারণে, অর্থনীতি আর বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের ধারাবাহিক ‘তুচ্ছ এই পদক্ষেপগুলো’ তেমন গুরুত্ব বহন করে না। চীনের সাথে প্রতিযোগিতা করার শক্তি ভারতের নেই, ভারত চীনের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ এখনও হয়নি যে, তার বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে চীন।

এসএএম: বিআরআই খাতে উল্লেখ করার মতো নতুন মাইলফলকগুলো কি? প্রকল্প নির্মাণ ছাড়াও বিআরআইকে ঘিরে চীন কি কূটনীতিক/রাজনৈতিক কাঠামো গড়ার দিকে যাবে চীন?

প্রফেসর চেং: বেল্ট অ্যান্ড রোড উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে উঠেছে আলোচনা, অংশগ্রহণ এবং অভিন্ন সুফল লাভের উপর। এর অর্থ হলো প্রকল্পের বিনিয়োগের বিষয়টি যৌথভাবে আলোচনা করা হবে, অবকাঠামো একত্রে নির্মাণ করা হবে, এবং এর অর্জনটা সবাই ভাগাভাগি করবে। আমাদেরকে অবশ্যই জাতিসংঘ সনদের নিয়ম নীতি মেনে চলতে হবে। আমাদের অবশ্যই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি মূলনীতি মেনে চলতে হবে, যেগুলো হলো: সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডার প্রতি সম্মান জানানো, অনাগ্রাসনের চর্চা করা, একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ, এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সাম্য ও পারস্পরিক উপকারের বিষয়গুলো সমুন্নত রাখা। 

চীন ২০১৯ সালে ১৬টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে বিআরআই সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মোটা সহযোগিতা চুক্তির সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। বেশ অনেকগুলো বড় ধরনের প্রকল্পের কাজ ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে চীনের ইউনান প্রদেশ ও লাওসের মধ্যে রেললাইন সংযোগ, জাকার্তা-বান্ডুং উচ্চ-গতির রেলওয়ে, হাঙ্গেরি আর সাইবেরিয়ার মধ্যে রেলওয়ে নির্মাণ, মোম্বাসা-নাইরোবি রেলওয়ে, চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর এবং চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর, ইত্যাদি। চীন খোলামেলা ও সততার ধারণার সাথে একাত্ম থাকবে, এবং উচ্চ স্ট্যান্ডার্ড, মানুষের জীবিকা এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। 

এসএএম: চীনা অর্থায়নের কারণে যে সব দেশে ঋণ সঙ্কট সৃষ্টির উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তাদের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?

প্রফেসর চেং: বন্ধুপ্রতীম যে সব দেশ তহবিলের অভাবে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে, চীন তাদেরকে অব্যাহত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে বিনিয়োগ আর ঋণ রয়েছে। তবে, চীনের ঋণকে কিছু পশ্চিমা মিডিয়া ‘ঋণের ফাঁদ’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। 

পশ্চিমা মিডিয়ার এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগের পিছনে মূলত মার্কিন কর্তৃপক্ষের মদদ রয়েছে। আসলে বিশ্বে নিজেদের আধিপত্যের অবস্থানটা ধরে রাখতে, উদীয়মান বাজার অর্থনীতির উত্থানকে ব্যাহত করতে, এবং চীনের বেল্ট অ্যাণ্ড রোড উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার মতো দেশগুলোকে অনুন্নত অবস্থায় রাখার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এই জনমত তৈরির যুদ্ধ শুরু করেছে। 

একটা উদাহরণ দেই। বেশি দিন হয়নি, পাকিস্তানে পেশোয়ার-করাচি মোটরওয়ের সুক্কুর-মুলতান অংশের কাজ সময়ের আগেই শেষ হয়েছে। সুক্কুর-মুলতান মোটরওয়ে ৩৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক, যেখানে ২.৯ বিরিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই মোটরওয়েটি নির্মাণ করেছে চীনের একটি নির্মাণ কোম্পানি এবং অর্থায়ন করেছে চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক। সে কারণে পাকিস্তান সরকারের উপর এখানে কোন আর্থিক বোঝা নেই। এই বিশ্বাস রয়েছে যে, মোটরওয়েটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর এটা অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে যাবে। বিনিয়োগের অর্থটাই শুধু ধীরে ধীরে এখানে উঠে আসবে না, বরং পাকিস্তানের জন্যও এটা কর রাজস্ব সৃষ্টি করবে। 

এই মোটরওয়েটি নির্মানের সময় প্রায় ৩০,০০০ স্থানীয় শ্রমিক সরাসরি এখানে কাজ করেছেন। আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোর মাধ্যমে আরও ৪০,০০০ এর বেশি স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সময়, চীনা নির্মাণ কোম্পানি দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং ৪৫০০ এর বেশি সরঞ্জাম অপারেটর এবং ২,৩০০ জন ব্যবস্থাপনা ও টেকনিক্যাল ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। 

চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বন্ধুপ্রতীম কোন দেশে প্রকল্প নির্মাণের সাথে জড়িত হয়, তখন তারা ওই দেশকে সাহায্য করার উপর, তাদের সক্ষমতা ও স্বাধীন উন্নয়ন সক্ষমতা বাড়ানোর উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকে। 

এসএএম: রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়ায় বাংলাদেশ অখুশী হয়েছে। এই ইস্যুতে চীনের সবশেষ অবস্থান কোথায়?

প্রফেসর চেং: বাংলাদেশ আর মিয়ানমার উভয়েই চীনের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং ভালো বন্ধু। রোহিঙ্গা ইস্যুতে, আমি মনে করি না যে, চীন মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে, তাই বাংলাদেশের বন্ধুদের অখুশি হওয়ার প্রয়োজন নেই। 

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এই ইস্যুটির যথাযথ সমাধানের ব্যাপারে চীন একটা ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। চীন সবসময় বিশ্বাস করেছে যে, দ্বিপাক্ষিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টির সুরাহা হওয়া উচিত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উচিত একটা ইতিবাচক ও ভালো পরিবেশ তৈরি করা যাতে বাংলাদেশ আর মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এগিয়ে নিতে পারে। 

চীন বিশ্বাস করে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ আর মিয়ানমার নিশ্চিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার একটা সমাধান বের করতে পারবে। প্রয়োজনে চীন এখানে আরও সহায়তা ও সমর্থন দিতে প্রস্তুত রয়েছে। 

এসএএম: বাংলাদেশে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতা একটা বাস্তবতা কিন্তু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায় চীনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য কি?

প্রফেসর চেং: অর্থনৈতিক আর বাণিজ্য প্রতিযোগিতাটা খুবই স্বাভাবিক। এই জায়গাটাতে খুব বেশি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আমাদের উচিত নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যাপারে চীন আর ভারতের শুরুটাই ভিন্ন রকম। ভারত সবসময় অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। অন্যদিকে চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সমান অংশীদার মনে করে।

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের স্বাধীন সক্ষমতা বাড়াতে ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের স্ট্যাটাসকে আরও শক্তিশালী করতে চায় চীন এবং তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সমুন্নত রেখেই সেটা করতে চায় তারা। 

২০১৯ সালে চীন আর ভারতের নেতাদের মধ্যে যে দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে, সেখানে দুই দেশ দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকাতে ‘চীন-ভারত প্লাস’ ফর্মুলা অনুযায়ী নিজেদের কর্মকাণ্ড চালানোর ব্যাপারে, এবং বাধাহীন আঞ্চলিক সংযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। সেই স্পিরিট অনুসারেই, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে চীন ভারতের সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। 

এসএএম: বাংলাদেশ বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতকে স্থল ও জলপথে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। আপনি কি মনে করেন, চীনের সাথে সঙ্ঘাত/যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারত এই নেটওয়ার্ককে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে?

প্রফেসর চেং: চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশসহ ট্রান্স হিমালয় অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আর স্থিতিশীলতার আশা করে চীন। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীন, ভারত আর অন্যান্য দেশগুলোর যে জরুরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ রয়েছে, সেটা ট্রান্স হিমালয় অঞ্চলে কোন যুদ্ধ বাধতে  দেবে না। চীন ভারতের সাথে বাস্তবসম্মত সহযোগিতার সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং চীন আশা করে যে, আঞ্চলিক আধিপত্যের ধারণা বাদ দিয়ে ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে। এ অঞ্চলের সবগুলো দেশের মৌলিক স্বার্থেই এটা করা উচিত। 

এসএএম: বাংলাদেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রকল্পে চীনের আগ্রহ কম। অর্থনীতি বহির্ভূত সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা কি চীনের রয়েছে?

প্রফেসর চেং: ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের চীনা দূতাবাসে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। ৪১ বছর ধরে আমি চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছি। আমার দৃষ্টিতে, চীন আর বাংলাদেশের সম্পর্ক সবসময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। দুই দেশের মধ্যে যে বাস্তবভিত্তিক সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে, সেটা শুধু অর্থনীতি আর বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এর প্রকাশ ঘটেছে। 

৪ অক্টোবর চীন আর বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৪৫তম বার্ষিকী পূর্ণ হয়েছে। দুই দেশের নেতারা পরস্পরের মধ্যে অভিনন্দন বার্তা বিনিময় করেছেন। চীনা নেতারা বলেছেন যে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় চীন। চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বাস্তবসম্মত সহযোগিতা জোরদার করতে চায়, দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চায় এবং বাংলাদেশের সাথে মিলে বেল্ট অ্যাণ্ড রোড নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিতে চায়, যাতে চীন-বাংলাদেশ কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারিত্বের বিষয়টিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়। 

এসএএম: ভবিষ্যতে চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও বাংলাদেশীর জন্য কি প্রবেশের সুবিধা বাড়বে?

প্রফেসর চেং: ২০১৯ সালে চীন সরকারের স্কলারশিপের পরিধি আরও বেড়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে চীনে লেখাপড়ার জন্য ১৮২টি দেশের ৪০,৬০০ জন শিক্ষার্থী চীন সরকারের স্কলারশিপ পেয়েছে। চীনে যত শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে, তাদের মধ্যে এই সংখ্যা ছিল ১০.২১%। 

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বেড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের জন্য চীন সরকারের স্কলারশিপ কর্মসূচি যথাযথভাবে সাজানো উচিত, এবং চীন আর বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত পরস্পরের মধ্যে আরও বেশি সহযোগিতা বাড়ানো। 

(চেং শিঝোং সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাণ্ড ল’-এর ভিজিটিং প্রফেসর, চারহার ইন্সটিটিউ্টের সিনিয়র ফেলো, দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোতে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে, এবং জাতিসংঘের সাবেক সিনিয়র সামরিক পর্যবেক্ষক)