আমরা লাইভে English শনিবার, জুন ০৩, ২০২৩

সফল হতে হলে নেতাদের ভালো উপদেষ্টা রাখতে হয়

column-eng-10-04-2020-1
ইমরান খানের সঙ্গে উপদেষ্টা মুইদ ইউসুফ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ১৯৬৪ সালে আমেরিকান গৃহযুদ্ধে কনফেডারেসির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জেনারেল ইউলিসিস এস গ্রান্টকে মার্কিন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ১৮৬৫ সালে জয়লাভ করেন। যুদ্ধের সময় তার প্রায় সব মূল স্টাফ ছিলেন বেসামরিক।

গ্রান্ট ১৮৬৯ সালে ৪৬ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮তম প্রেসিডেন্ট হন। ওই সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। নিজে অত্যন্ত বিবেকবান হওয়া সত্ত্বেও তার প্রশাসন নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। গ্রান্ট তার আশপাশে থাকা লোকজনের মধ্যে তার চিফ অব স্টাফ রাওলিনসকে সবচেয়ে অপরিহার্য বিবেচনা করতেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিওএস হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ৫ মাসের মাথায় তিনি যক্ষ্মায় পরলোকগমন করেন।

এরপর জেনারেল গ্রান্টের দুর্ভাগ্য হলো যে তার ঘনিষ্ঠ অনেক উপদেষ্টা তাকে ভয়াবহভাবে ডুবিয়ে দেয়। রাওলিনসের স্থানে নিয়োগ পাওয়া অরভিল ব্যাবককের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়, ক্যাবিনেট বিভাগ ও নিয়োগে তিনি কলকাঠি নাড়াতেন বলে অভিযোগ আসে।

যুদ্ধক্ষেত্রে অভিন্ন অভিজ্ঞতার কারণে ব্যাবকককে সব ধরনের রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে গ্রান্ট আড়াল করতেন। ১৮৭৫ সালে ‘উইস্কি রিং’-এর সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত হলেও গ্রান্ট তাকে রক্ষা করেন তার পক্ষ হয়ে লিখিত সাফাইয়ের কারণে। ফলে ব্যাবকক খালাস পান।

তবে আরো কিছু কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাবকককে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যামিলটন ফিশের কাছ থেকেও চাপ এসেছিল। তাকে বিবেচনা করা হয় গ্রান্টের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে দক্ষ অফিসার।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রেসিডেন্ট গ্রান্টের মন্ত্রিসভার সদস্য, স্টাফ ও উপদেষ্টারা ছিলেন যেনতেনভাবে বাছাই করা। নিজে খুবই সৎ হলেও জেনারেল গ্রান্ট মানুষ চিনতেন না। তিনি ভুল লোককে নিয়োগ করতেন এবং অসৎ ও সুযোগসন্ধানী হিসেবে প্রমাণিত লোকদের খুবই অনুগত হয়ে পড়তেন।

তার প্রশাসনের কেলেঙ্কারি তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই আমলেই ছিল। তিনি সদেচ্ছাপূর্ণ লোক হলেও ছিলেন ক্ষীণদৃষ্টির। তিনি এখন এক পক্ষের, পরে আরেক পক্ষের কথা শুনতেন। কখনো জেনারেলদের, কখনো মন্ত্রিসভার সদস্যদের, কখনো রাজনীতিবিদ, কখনো উপদেষ্টাদের কথায় কান দিতেন। ইতিহাসবিদ হেনরি ওয়াল্টম্যান বলেছেন, গ্রান্টের রাজনৈতিক আনাড়িপনা তার কার্যকারিতা নস্যাৎ করে দিয়েছে। তার সততা ও আন্তরিকতার কথা কি কারো মনে আছে?

যেসব ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সৎ বা দক্ষ নয়, তারা সাধারণত নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকে। এদের কারো থাকে ক্ষমতার লিপ্সা, কারো থাকে প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা, কারো থাকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তির ইচ্ছা। আবার অনেকে ঈর্ষার বশবতী হয়ে বা দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত বিবেচনা করে কাউকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে।

অনেক নেতা তাদের উপদেষ্টাদের কারণে মর্মান্তিক পরিণতির মুখে পড়েছেন। ইংল্যান্ডের আনাড়ি ও ধার্মিক রাজা ষষ্ট হেনরি রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে আগ্রহী ছিলেন না। তার ঘনিষ্ঠ স্বজনসহ একদল উপদেষ্টা তাকে শাসক হিসেবে অনুপযুক্ত ঘোষণা করে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণ করে।

ভালো ও খারাপ, উভয় ধরনের উপদেষ্টাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। অনেক সফল উপদেষ্টা তাদের নেতাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে সফল হয়েছিলেন। 

১. চানক্য ছিলেন মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। তিনি মৌর্য রাজবংশের চন্দ্রগুপ্তকে তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে সহায়তা করেছিলেন। তার গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র হিন্দু রাজনীতিবিদ ও কুটনীতির পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। 

২. মোগল সম্রাট আকবরের হিন্দু উপদেষ্টা বীরবলের বিজ্ঞতা ছিল নজিরবিহীন। তিনি আকবরের সামনে আসা সমস্যা সমাধানে রসবোধ ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন।

৩. প্রুসিয়ার প্রথম উইলহেমের ও পরে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ওট্টো ভন বিসমার্ক ছিলেন জার্মান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জার্মান এলাকাকে ঐক্যবদ্ধ করার মূল শক্তি। তিনি জার্মানির বিশ্বখ্যাত আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনী নির্মাণ করেছিলেন।

৪. পরিচিত বিশ্বের বেশির ভাগ স্থান শাসনকারী চেঙ্গিস খানের বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ছিলেন ইউলু চুকাই। চেঙ্গিস খানকে চুকাই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ওই সময়ে বিদ্যমান বিজিত নগরী ধ্বংস করার বদলে কর আরোপ করতে। তার যুক্তি ছিল এই যে বিজিত নগরী থেকে পাওয়া অর্থ ও জনশক্তি ভবিষ্যতের বিজয়ে কাজে লাগবে।

ভালো উপদেষ্টাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা তাদের শাসকের প্রতি অনুগত থাকে, তাদের ছাপিয়ে যায় না। তারা সাধারণত আড়ালে আবড়ালে থাকে, নিজেদের তেমনভাবে প্রকাশ করে না।

অবশ্য কিছু কিছু অকাট মুর্খ্য দেশের জন্য না হলেও তাদের নেতার জন্য অপরিহার্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। এ ক্ষেত্রে আসিফ আলি জারদারির প্রধান উপদেষ্টা সালমান ফারুকির কথা বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন একেবারে অসৎ ও দুর্বৃত্ত। তবে রাষ্ট্র ও সিনিয়র আমলাদের পরিচালনা করতে তার গভীর জ্ঞান ছিল। জারদারির কাছে তিনি ছিলেন অপরিহার্য। কোন আমলা সৎ, কে নয়, তা তার জানা ছিল। তিনি জানতেন, কোন আমলা অর্থ হাসিলের জন্য কোন আকষর্ণীয় মন্ত্রণালয় চায়।

তিনি সুশাসনের জন্য দক্ষ ব্যক্তিদের কাজে লাগাতেন। তবে দুর্নীতি আর সুশাসন একসাথে চলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত জারদারির শাসন ব্যর্থ হয়।

নওয়াজ শরিফও একই ফরমুলা ব্যবহার করেন। শাহবাজ শরিফ ছিলেন পাঞ্জাবে একেবারে সঠিক। কিন্তু আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির জন্য উভয়েই ব্যর্থ হন।

ইমরান খান সরকারের একটি প্রধান সমস্যা হলো তার উপদেষ্টাদের মান ও দায়বদ্ধতা। তার উপদেষ্টাদের কয়েকজন সন্দেহাতীতভাবেই অটল। কিন্তু অনেকে খুবই হালকা। সরকার পরিচালনা একটি টিম ওয়ার্কের বিষয়। রাজনীতিবিদ ও উপদেষ্টাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বোঝাপড়ার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করতে হয়। তাদেরকে হতে হয় আন্তরিক ও সৎ। তাদেরকে একে অপরকে বিশ্বাস করতে হয়। এ ধরনের সম্পর্ক বাড়াতে হয়, লালন করতে হয়। 

ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের মডেলে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করেছেন। তবে তাদেরকে কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি। আর এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে মুইদ ইউসুফকে। তিনি ভালো লোক। কিন্তু এ ধরনের দায়িত্ব সামাল দেয়ার মতো দক্ষতা তার নেই। উপদেষ্টা গ্রহণ করতে হয় নেতার বার্তা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারার সক্ষমতার উপর নির্ভর করে।

পাকিস্তানের প্রয়োজন ইমরান খানের মতো কোনো আন্তরিক লোকের। কারণ দেশের প্রয়োজন ভালো উপদেশ দিতে পারে এমন লোকের। কিন্তু যারা ব্যক্তি স্বার্থে বা আনাড়ি, তাদের নিয়োগ করা মানে কেবল ইমরান খানকেই ডুবিয়ে দেয়া নয়, দেশেরও ক্ষতি করা।

 

লেখক: প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা