বেকায়দায় ভারত সরকার, পুরনো দাবি থেকে সরতে নারাজ এনএসসিএন (আইএম)

নাগা পতাকা হাতে এক শিশুকে আদর করছে এক নাগা সেনা
ন্যাশনাল সোস্যালিষ্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ডের (আইজাক-মুইভা) দুটি ‘মৌলিক দাবি’ গ্রহণ করতে ভারত সরকারের অস্বীকৃতির ফলে ছয় দশক ধরে চলতে থাকা নাগা সমস্যার নিষ্পত্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
স্বাধীনতাকামী ওই দলটি ১৯৯৭ সালে দিল্লির সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করার পর থেকে ভারত সরকারের সাথে উপর্যুপরি আলোচনা করে যাচ্ছে। পরে অন্যান্য বিদ্রোহী অংশকে শান্তিপ্রক্রিয়ায় আনা হয়। ইতোমধ্যেই ২৩ বছর কেটে যাওয়ায় এটি বিশ্বের যেকোনো স্থানের সবচেয়ে পুরনো শান্তি আলোচনাগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।
শান্তিচুক্তি সইয়ের পূর্ব শর্ত হিসেবে দুটি দাবি জানিয়েছে এনএসসিএন-আইএম। এ দুটি হচ্ছে নাগাল্যান্ডের জন্য আলাদা পতাকা এবং পৃথক নাগা সংবিধান বা ইয়েজাবো। কিন্তু মোদি সরকার তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে পুরো প্রক্রিয়াটিই এলোমেলো হয়ে পড়েছে। এনএসসিএন-আইএম ও ভারত সরকারের মধ্যে ২০১৫ সালে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই হওয়ার পর চারটি ক্রিসমাস কেটে গেছে, কিন্তু এই কাঠামোর ভিত্তিতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
দুই মাস আগে ভারতের মধ্যস্ততাকারী ও গোয়েন্দা ব্যুরোর সাবেক সহকারী প্রধান আর এন রবি বলেছিলেন যে চূড়ান্ত নাগা নিষ্পত্তি অতি সন্নিকটে। কিন্তু ওই আশা উবে গেছে। এর ফলে সঙ্ঘাত জর্জরিত ভারতের উত্তর-পূর্বে হতাশার কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য, নাগা বিদ্রোহ হলো এই অঞ্চলের সব বিদ্রোহের জননী। ফলে তাদের সাথে শান্তিচুক্তি হলো এখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারত সরকারের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, একটি সার্বভৌম জাতির অধীনে দুটি সংবিধান ও দুটি জাতীয় পতাকা থাকতে পারে না। অনুচ্ছেদ ৩৭০ ও ৩৫ক বাতিলের মাধ্যমে আমরা জম্মু ও কাশ্মিরের আলাদা জাতীয় পতাকা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়েছি। ফলে আমরা আর এটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।
বিভিন্ন নাগা মধ্যস্ততাকারীর সাথে বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা আলোচনার পর যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে। অবশ্য, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণের পর শন্তি আলোচনা ত্বরান্বিত হয়েছিল। আইবির অবসরপ্রাপ্ত উপপ্রধান আর এন রবিকে প্রথমে মধ্যস্ততাকারী এবং পরে নাগাল্যান্ডের গভর্নর করা হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নাগা বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে আসার জন্য।
এর পরপরই মধ্যস্ততাকারী পরিষ্কার করেন যে নাগারা দুটি মৌলিক দাবিতে অটল রয়েছে। এর একটি হলো আশপাশের রাজ্যগুলোর নাগা অধ্যুষিত এলাকাগুলো একীভূত করা ও সার্বভৌম নাগাল্যান্ড বা তাদের ভাষায় নাগালিম প্রতিষ্ঠা করা। বাকি দাবিগুলো আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।
উভয় পক্ষ রাজি হয় এবং ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই হয় প্রধানমন্ত্রী মোদি, ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ও এনএসসিএনের সর্বোচ্চ নেতা মুইভার উপস্থিতিতে। প্রধানমন্ত্রীর লোক কল্যাণ মার্গে হয়েছিল চুক্তি সই অনুষ্ঠান।
আলোচনার সাথে পরিচিত আইবির এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন যে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টে সুস্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে যে ভবিষ্যতের যেকোনো আলোচনা হবে ভারতীয় সংবিধানিক কাঠমোর আওতায়। এখানে নাগা সংবিধানের কোনো কথা উল্লেখ নেই।
তিনি বলেন, এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনার সময় অশীতিপর নাগা নেতা ইউ-টার্ন দিয়ে সহ-অস্তিত্ব বজায় রাখা ও অভিন্ন সার্বভৌমত্বের সেই পুরোনা দাবি আবার উত্থাপন করছেন। তিনি নাগা পতাকা ও নাগা সংবিধানের দুটি ইস্যু একীভূত করার ওপর জোর দিচ্ছেন। এটি অবাস্তব এবং তা আলোচনার চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, সরকার যদি চূড়ান্ত চুক্তির আগে আলাদা নাগা পতাকা ও আলাদা নাগা সংবিধানের দাবিকে পূর্বশর্ত হিসেবে গ্রহণ করে নেয় তবে তার অর্থ এই হতে পারে যে সার্বভৌম নাগাল্যান্ডকে গ্রহণ করে নেয়া এবং তিনটি প্রতিবেশী রাজ্য মনিপুর, আসাম ও অরুনাচল প্রদেশ ও মিয়ানমারের নাগা-অধ্যুষিত এলাকাগুলো একীভূত করার দাবিগুলো মেনে নেয়া। ভারত সরকার এই অধ্যায় আবার শুরু করতে পারে না। রবি যখন এনএসসিএম-আইএমের সাথে আলোচনা শুরু করেন, তখনই ওই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
গত বছরের ২৮ জুলাই নাগাল্যান্ডের গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগ দিয়ে আর এন রবি দিল্লিতে এনএসসিএন-আইএমের মহাসচিব মুইভার সাথে সাক্ষাত করে ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে নাগাদের অন্তর্ভুক্ত করা নিশ্চিত করে চূড়ান্ত সমাধানের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। ৮৬ বছর বয়স্ক নাগা নেতাকে রবি স্মরণ করিয়ে দেন যে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টে ‘অন্তর্ভুক্ত’ শব্দটি লেখা থাকবে। এনএসসিএন-আইএমের সর্বোচ্চ নেতা মুইভা এতে ক্রুদ্ধ হয়ে অভিযোগ করেন যে রবি তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টে লেখা ‘অন্তর্ভুক্ত’ শব্দটির অর্থ পরিবর্তন করেছেন।
মুইভা দাবি করেন, ‘অন্তর্ভুক্ত’ শব্দটির অর্থ হলো চূড়ান্ত চুক্তিতে সম্মত হওয়া সব শর্ত। সফল সমাধান দুটি সত্ত্বার মধ্যে নতুন অন্তর্ভুক্তমূলক ও টেকসই সম্পর্কের ব্যবস্থা করবে। তিনি বলেন, শব্দের ছলচাতুরিতে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। কিন্তু রবি তার অবস্থানে অটল আছেন বলে জানা গেছে।
আরেকটি বিরোধপূর্ণ ইস্যু হলো ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির শীর্ষস্থানীয় ৫ এনএসসিএন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা।
ধারণা করা হচ্ছে যে মুইভা তার অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করে মধ্যস্ততাকারীর কাছে জানতে চেয়েছেন যে শান্তি আলোচনায় কেন এনআইএ হস্তক্ষেপ করছে এবং তিনি কেন এসএসসিএনের নেতা ও ক্যাডারদের রক্ষা করতে পারছেন না। রবি যুদ্ধবিরতি ব্যাপক মাত্রা লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে চুক্তিতে উল্লেখিত যুদ্ধবিরতির স্থানের বাইরে গোপন আস্তানা স্থাপনের কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় অব্যাহত রয়েছে এবং দৃশ্যত তিক্ততার সাথেই বৈঠকটি শেষ হয়েছে।
রবি ১ আগস্ট নাগাল্যান্ডের গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি প্রকাশ করেন যে প্রধানমন্ত্রী শান্তি আলোচনা তিন মাসের মধ্যে শেষ করতে বলেছেন। সেক্ষেত্রে সময়টি হয় চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে।
তবে মধ্যস্ততাকারীর ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজে’ অসন্তুষ্ট হয়ে এনএসসিএন-আইএম নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক বার্তায় নতুন মধ্যস্ততাকারী নিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তারা নাগাল্যান্ডের গর্ভনরের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চান না।
চলমান ইন্দো-নাগা শান্তি আলোচনায় রবি এখনো মধ্যস্ততাকারী রয়ে গেলেও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে সম্প্রতি চলমান ইন্দো-নাগা শান্তি আলোচনা তদারকির অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এদিকে এনএসসিএন-আইএম সর্বোচ্চ নেতা ‘হেবরনে’ তাদের সদরদফতরে গিয়ে প্রায় সব নেতার সাথে কথা বলে শান্তি আলোচনার সর্বশেষ অবস্থা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সব নেতা ও গ্রুপকে আরো খারাপ কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
অবশ্য ২ সেপ্টেম্বর নাগাল্যান্ডের নতুন গর্ভনর ও মধ্যস্ততাকারী রবি এনএসসিএন-আইএমের সাথে একান্তে আলোচনা করেন চুমুকেদিমা পুলিশ কমপ্লেক্সে। এতে মনে হয়েছে যে বরফ গলছে। দুই পক্ষ বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে নতুন দফা আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে যে উভয় পক্ষ ‘বিকল্প পন্থা’ নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন যাতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়। তবে মৌলিক দুটি দাবির কী হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, নাগা ন্যাশনাল পলিটিক্যাল গ্রুপস (এনএনপিজি) গঠনকারী এনএসসিএনের সাতটি গ্রুপ ভারত সরকাররের সাথে শান্তি চুক্তি সইয়ে বিলম্ব করা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য এনএসসিএন-আইএমকে দায়ী করেছে।
এনএনপিজি অভিযোগ করেছে যে এনএসসিএন-আইএম ইতোমধ্যেই তার দুটি মৌলিক দাবি (প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর নাগা-অধ্যুষিত এলাকাগুলো একীভূত করা এবং সার্বভৌমত্ব ইস্যু) বাদ দিতে সম্মত হয়েছিল আলোচনা শুরুর আগেই। কিন্তু এখন নাগা জনগণের ভাবাবেগকে প্রশমিত করার জন্য এসব ইস্যু উত্থাপন করছে এনএসসিএন-আইএম নেতৃত্ব।
১৪ নাগা উপজাতীয় নেতা সম্প্রতি বিরোধ চিরতরে মেটানোর জন্য শান্তি আলোচনা ত্বরান্বিত করার জন্য এনএসসিএন-আইএম নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা ইন্দো-নাগা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য একটি কাজ চালানোর মতো সমাধান বের করার উপদেশও দিয়েছেন।
অনেকে সন্দেহ করছেন যে রবি, দোভাল ও আইবির জুনিয়র অফিসারেরা অন্যান্য নাগা উপদলকে পূর্ব নাগাল্যান্ডে উপজাতীয় সীমানার মধ্যে নতুন রাজ্য সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বশ করেছেন এবং এনএসসিএন-আইএমকে নিঃসঙ্গ করার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু এই লেখক মুইভাকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন। তিনি ১৯৮৬ সালে চীনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই অভিজ্ঞ গেরিলা নেতার প্রথম সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। মুইভা মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট। ভোলা উচিত নয় যে চীনে ‘রাজনৈতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত’ এই ব্যক্তি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সর্বোচ্চ সময়ে চীনে ছিলেন এবং ২৩ বছর ধরে দিল্লির সাথে আলোচনার সময় তার দক্ষতা শানিত করেছেন।
অবশ্য বারবার বিভক্তির ফলে নাগা বিদ্রোহী আন্দোলন আর অতীতের স্থানে নেই। আর দিল্লিও ফাটল ধরানোর জন্য চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি দিল্লি বিশ্বাস করে যে তারা সাত হাজার সদস্যবিশিষ্ট এনএসসিএন (আইএম)কে বাদ দিয়ে ছোট ছোট বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে চুক্তি সই করে নাগা সমস্যার সমাধান করে ফেলবে, তবে তার মানে হবে যে তারা ক্যান্সারের চিকিৎসা বাদ দিয়ে মালিশেই আরোগ্য লাভে বিশ্বাস করেছে। আমরা কি আবারো ১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি করব? ওই সময় মুইভা ও পরলোকগত আইজ্যাক সুইয়ের নেতৃত্বাধীন চীনফেরত যোদ্ধাদের বাদ দিয়ে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের সাথে চুক্তিতে সই করেছিলাম। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়েছিল?