সাবেক ফার্স্ট লেডি হতে যাচ্ছেন মিয়ানমারের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট

মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) নির্বাচনী বিজয় একেবারে শীর্ষ পর্যায়সহ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করতে দলটির নেতাদের সাহসী করে তুলছে। খুবই সম্ভব যে নতুন একজন প্রেসিডেন্ট ও নতুন চেহারার মন্ত্রিসভা দেখা যাবে। আর এর মধ্যেই দেশটির মহা শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর মধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।
এখন পর্যন্ত সম্ভাব্য পাইপলাইনে থাকা পরিবর্তন নিয়ে ঠোঁট একেবারে বন্ধ করে রেখেছে এনএলডি নেতৃত্ব। শীর্ষ পদ ও মন্ত্রী পদে কারা আসছেন, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও মিডিয়ায় নানা গুঞ্জন চলছে। তবে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে ইঙ্গিত প্রদান শুরু হয়েছে।
এনএলডি যে পরিবর্তনের কথা ভাবছে তা নিয়ে গুঞ্জনের উৎস হলেন বর্তমানে পরলোকগত সাংবাদিক উইন তিন। তিনি ছিলেন এনএলডির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ১৯ বছর কারাগারে ছিলেন, সামরিক হয়রানি ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করেন, এনএলডি হলো জনগণের দল। তিনি ২০১৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ধারণা আঁকড়ে ছিলেন। এখন তার নীতিই এনএলডি নতুন করে গ্রহণ করতে যাচ্ছে।
দলের শীর্ষ নেতাদের সূত্র অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য এনএলডির তিন নেতা বিবেচনায় রয়েছেন। তারা হলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট উইন মিইন্ত। তিনি প্রেসিডেন্ট হতিন কিয়াওয়ের স্বাস্থ্যগত রহস্যজনক কারণে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর স্বেচ্ছায় অবসর নেয়ার পর ওই দায়িত্ব লাভ করেন। এনএলডির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টের তালিকায় আরো আছেন বর্তমানে মান্দালয়ের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ড. জাও মিয়ন্ত মঙ। তাকে অঙ সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডির কার্যত নেতা মনে করা হয়। সম্ভাব্য তৃতীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হতিন কিয়াওয়ের স্ত্রী সু সু লউইন। তিনি এনএলডির প্রখ্যাত এমপি। এই নারী হলেন এনএলডির মূল প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ইউ লউইনের মেয়ে।
মিয়ানমারের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সাবেক ফার্স্ট লেডি সু সু লউইনের সামনে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো অপসারণ করা হচ্ছে।
এনএলডির একটি সূত্র জানিয়েছে, তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করা হলে আমরা আসিয়ান ও বিশ্বকে দেখাতে পারব যে মিয়ানমারে বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। মিয়ানমারের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেন মিয়ানমারের সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই ভালো ইমেজ। এটা মিয়ানমারের আধুনিকায়নের প্রতিনিধিত্ব করবে, প্রমাণ করবে যে মিয়ানমারে নারীরা আছে ক্ষমতার সামনের কাতারে এবং দেশটিতে পরিবর্তন হচ্ছে।
দলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনাও আছে। দলে নতুন গতিশীলতা আনতে এবং সমর্থক ও ভোটার, সেইসাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য, আঞ্চলিক ও রাজ্য প্রশাসন ও পার্লামেন্টের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও সহযোগিতার জন্য নতুন ও তরুণতর রক্ত আনার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে উত্তরাধিকারের জন্য প্রস্তুতির বিষয়টিও রয়েছে।
২০০৮ সালের সামরিকপন্থী সংবিধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশের প্রেসিডেন্ট দলের দৈনন্দিন বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এর ফলে মান্দালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মিন্ত মঙকে প্রেসিডেন্ট পদ হিসেবে খুব বেশি সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে না। কারণ গত কয়েক বছর ধরে তিনি দলের খুবই কার্যকর নেতা হিসেবে কাজ করছেন। আগামী ৫ বছরের পরিবর্তন ও অভ্যন্তরীণ উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য তাকে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হবে। তাকে ওই কাজের জন্য রাখা হলে তার প্রেসিডেন্ট হওয়া হবে না।
আবার তার স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে তার দেহে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। অবশ্য তার ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে স্পিকারের দায়িত্ব পালনকারী প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ত গত কয়েক বছরে মিইয়ে গেছেন। তিনি সম্ভবত আগের অবস্থানে ফিরে গিয়ে দলীয় কাজে আরো বেশি সময় দেবেন মান্দালয়ের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে।
এদিকে এনএলডির সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হবে বেসামরিক ও সামরিক সম্পর্ক। বর্তমান কমান্ডার-ইন-চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন আং হলাইঙ আগামী বছরের জুনের শেষ দিকে অবসর গ্রহণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে তাকে নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। তার মেয়াদ আরো ৫ বছর বাড়ানো হবে বলেও জল্পনা রয়েছে। ২০১৬ সালেও তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। তবে এনএলডি সরকার সম্ভবত এবার আর তা গ্রহণ করবে না। এই পদে কারো নিয়োগ অনুমোদনের জন্য বর্তমান প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে। বর্তমানে সেখানে ৬ সদস্যর মধ্যে ৫ জনই সামরিক বাহিনীর। ফলে সিদ্ধান্ত সমঝোতার ভিত্তিতে হতে পারে। তা না হলে বড় ধরনের সাংবিধানিক সঙ্কটের সূচনা হতে পারে।
শীর্ষস্থানীয় চিন অ্যাক্টিভিস্ট ও চিন রাজ্যের এনএলডির নির্বাচন কমিটির সদস্য ড. সাসা বলেন, নির্বাচনের ফলাফলে সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাখ্যানের চিত্র ফুটে ওঠেছে, সেইসাথে এনএলডির পরিবর্তনের ম্যান্ডেটও জোরদার করেছে। ফলে ভবিষ্যতে এই সরকারকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ করতে সামরিক বাহিনীকে দুইবার ভাবতে হবে। তবে সামরিক বাহিনীর প্রতি মনোভাব অবশ্যই সমন্বয়মূলক ও সহযোগিতামূলক হতে হবে।
সামরিক বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, সিনিয়র জেনারেল ভাইস প্রেসিডেন্টের পদটি গ্রহণ করতে অনীহ। উল্লেখ্য, ওই পদটিতে নিয়োগ দেয় সামরিক বাহিনীই। অপর দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে থাকে পার্লামেন্টের যথাক্রমে উচ্চ ও নিম্ন কক্ষ। একটি সূত্র জানিয়েছে, সিনিয়র জেনারেলের চোখ প্রেসিডেন্ট পদে।
তবে এনএলডির এখন নজর মন্ত্রিসভা গঠনের দিকে। তাছাড়া রাজ্য ও অঞ্চলগুলোতেও নিয়োগ দিতে হবে। মিয়ানমার ইউনিয়নের সাতটি রাজ্য ও সাতটি অঞ্চল রয়েছে। এছাড়া আছে ছয়টি স্বশাসিত জোন ও বিভাগ, একটি ইউনিয়ন টেরিটরি।
দলের মুখপাত্র মনোওয়া আং শিন বলেন, দেশের রাজ্য ও অঞ্চলগুলোতে নিয়োগে নেতৃত্ব দেবেন স্টেট কাউন্সিলর সু চি নিজে। ২০২১ সালের প্রথম দিকের মধ্যেই এসব নিয়োগ সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আর এর মাধ্যমে তারা ২০২০ সালের নির্বাচনী ইস্তেহার পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে চাচ্ছে।