আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, মার্চ ২১, ২০২৩

অতীতে না তাকিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের

TOP NEWS-10-12-2020

সম্পর্কে বাধা হয়ে থাকা পারস্পরিক অভিযোগ, অন্তরের ক্ষত ও প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এগিয়ে যাওয়ার জন্য পঞ্চাশটি বছর যথেষ্ঠ দীর্ঘ সময়। চরম বৈষম্যের পরিণতি ছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধ। ইতিহাস লেখায় দুই দেশেরই সমস্যা থাকার পরও এখন সময় এসেছে তাদেরকে অতীতকে চাপা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।

৮০’র দশক ও একবিংশ শতকের সূচনা পর্যন্ত ২৫ বছর ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মেরামত চলছিল। মিটমাটের পথে একটি বড় কাজ ছিলো হামদুর রহমান রিপোর্ট প্রকাশ। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার করে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া অনেককে ফাঁসি দেয়া হয়। এটা দুই দেশের সম্পর্কে বিষ ঢালে।

একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে শুধু নিজেদেরই নয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী বংশোদ্ভুত যারাই ছিল তাদের সবার আচরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করতে হবে। ড. বেটিনা রোবটকার সঙ্গে যৌথভাবে আমার লেখা বই ‘সবুজের পরতে পরতে রক্ত’ [ব্লাড ওভার ডিফারেন্ট শেডস অব গ্রিন] পাকিস্তান ও বাংলাদেশ – দুই দেশেরই কিছু মানুষকে খুশি করতে পারেনি। তাই হোক।

তবে, উপেক্ষা করা হয়েছে এমন অনেক সত্য অকপটে নির্মমভাবে তুলে ধরায় ধন্যবাদ জ্ঞাপনকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। পাঞ্জাবি পিতা ও বাঙ্গালী মায়ের সন্তান হিসেবে আমার চেয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে আর কে এটা তুলে ধরতে পারবে?

অনিষ্পন্ন সমস্যাগুলো সমাধানের মধ্যে থাকতে পারে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে আনা অথবা তাদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক করে নেয়া। এতে বিনা দোষে শাস্তি পাওয়া থেকে একদল মানুষ মুক্তি পাবে। শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের চেয়ে ২০০৯ সালের পর তিনি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক অনেক বেশি শত্রুতামূলক হয়ে ওঠে। যুদ্ধাপরাধের বিচারে ভারতের উষ্কানী এই সম্পর্কে ক্ষোভ ও তিক্ততা সৃষ্টি করে।

ফ্রাঙ্কো-জার্মান মডেল

ফ্রান্স ও জার্মানি আজ দুটি শীর্ষস্থানীয় ইউরোপিয়ান অর্থনীতি। কেন? কারণ তারা তিক্ততা মাটি চাপা দিয়ে এগিয়ে গেছে এবং একটি সহযোগিতামূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এক শতাব্দির বেশি সময় দুই দেশ পরষ্পরকে কট্টর শত্রু বিবেচনা করতো। এর কিছুটা ভূখণ্ডগত, কিছুটা রাজনৈতিক। ভূমি বা সম্মানের জন্য তারা যুদ্ধ করেছে। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দেয়া ছাড়াও তাদের অর্থনীতি তছনছ হয়েছে। ১৯৪৫ সালে জার্মানির পরাজয় ঘটে। আর দখলদার শক্তি হিসেবে আবির্ভুত ফ্রান্স চেষ্টা করে জার্মানির সামরিক শক্তি যেন ফের মাথাচাড়া দিতে না পারে।

কিন্তু এবার তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির মতো ভুল করেনি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করে। ১৯৬৩ সালে ফ্রান্স ও জার্মানির এলিসি চুক্তি ছিলো নাটকীয়ভাবে পুরোপুরি ভিন্ন। শত বছরের শত্রুতা ও সংঘাত পেছনে ফেলে দুই দেশ পুনর্মিলনের বার্তা দেয় এবং ইউরোপিয়ান সমন্বয়ের সমর্থনে ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ভিত্তি রচনা করে। 

চুক্তি স্বাক্ষরকারীরা নিশ্চিত করেন যেন এটি শুধু কাগুজে দলিল না হয়ে দুই দেশের মানুষ পরস্পরকে জানার সুযোগ পায়, তারা কথা বলে ও পরস্পরের প্রশংসা করে। এই চুক্তি দুই জনগণকে কাছাকাছি করে। আমাদের অঞ্চলে এমন কিছু করা কি অসম্ভব?

১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ সফরকারী প্রথম সামরিক শাসক ছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ২০০২ সালে তিনি বাংলাদেশ সফরে গিয়ে জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ঘটনাকে দু:খজনক ও ঘৃণ্য হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ।
এর কয়েক বছর আগে আমি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে ঢাকা সফরের সময়সাভারের একই স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলাম। নিহতদের স্মরণে যখন মৌনভাবে দাঁড়িয়েছিলাম তখন সাভার পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এগিয়ে এসে আমাকে স্যালুট করে বললেন, স্যার, আমি আপনার ইউনিটি ছিলাম। এই মনোভাব বলার মতো এবং খুবই প্রতীকী।

১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তিনটি আধা-সজ্জিত পদাতিক ডিভিশন ছিল। আর রংপুরে ছিলো একটি ক্ষয়িষ্ণু সাঁজোয়া রেজিমেন্ট। আজ বাংলাদেশে নয়টি পদাতিক ডিভিশন। সবগুলোতেই ইনটিগ্রাল মিডিয়াম ট্যাংক রেজিমেন্ট রয়েছে। আর আমার মায়ের বাড়ি বগুড়ায় রয়েছে একটি সাঁজোয়া ব্রিগেড। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের নির্দেশ দিত তাহলে কি পরিস্থিতি হতো, ভাবা যায়?

বাংলাদেশের অর্জন

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অর্জনে পাকিস্তানের গর্ব করা উচিত। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ অর্থনীতিকে মুক্ত করে দিয়ে ‘শত ফুল ফুটতে’ দিয়েছিলেন। গত এক দশকে শেখ হাসিনা অর্থনীতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ১৯৮৮ সালের মার্চে আমি ‘একতার অর্থনীতি’ শীর্ষক একটি লেখা লিখেছিলাম। তাতে বলেছি: দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমেই বাণিজ্য দ্বারা আবদ্ধপ্রবণ এবং সম্পর্ক আদর্শিক প্রতিসাম্যভিত্তিক না হয়ে অধিকতর বিচক্ষণ ও টেকসইপ্রবণ হয়ে উঠছে। ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ইত্যাদি অভিন্ন স্বার্থ জাতিগুলোকে কাছাকাছি আনলেও তাদেরকে একটি বন্ধনে আবদ্ধ রাখার আঠা অবশ্যই হতে হবে অর্থনীতি। প্রত্যেক জাতি শেষ পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়। আর বাণিজ্যই তাদেরকে ‘দেয়া নেয়ার’ সুযোগ করে দেয়। 

আমার ২০০২ সালে লেখা ‘দুই দেশ এক জাতি’ নিবন্ধে বলেছি: পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চালু হওয়া উচিত। পরস্পরের দেশে রফতানি করলে অন্য দেশে রফতানির চাপ কমবে। তাছাড়া মানুষ প্রতিযোগিতামূলক দামের সুবিধা পাবে। এই দুই দেশের ভবিষ্যৎ হলো প্রতক্ষ্য মুক্ত বাণিজ্য। 

আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন মেজর আব্দুল মান্নান অসাধারণ এক উদ্যোক্তা। তার পোশাক কারখানা শুধু বাংলাদেশে নয়, সুদূর কম্বোডিয়া, মাদাগাস্কার, ইত্যাদি দেশে ছড়িয়ে আছে। তিনি পাকিস্তানি কাপড় অগ্রাধিকার দিতেন সবসময়। অতীতে বহুকাল বাংলাদেশী সেনা অফিসাররা প্রিশিক্ষণের জন্য পাকিস্তান যেতেন। ভারতের জোরালো আপত্তি উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা এই ধারা পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন বলে মনে করা হলেও গত কয়েক বছর ধরে দুই দেশর জনগণের মধ্যে যোগাযোগ পুরোপুরি অনুপস্থিত। দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভিসামুক্ত সফর, শুল্কবাধা অপসারণ ও ১৯৭১ সালের আগের মতো অবাধ চলাচলের সুবিধা চালু ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। 

১৯৯০ সালের মার্চে আমি ‘এইএসএসএ ধারণা’ শীর্ষক নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাবে বলেছি: বাংলাদেশ শব্দের আক্ষরিক মানে হলো বাঙ্গালীদের আবাস, যাদের মধ্যে রয়েছে মুসলমান ও হিন্দু। কলকাতা, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর মিলে এই অঞ্চলটি খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি ছাড়াই শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে টিকে থাকতে পারে। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক সত্য জানে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থানটি অসাধারণ। ইতিহাসের দিকে তাকালে এখানে অনেক জাতি-রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দেখা যাবে: বাংলা, বাংলাদেশ, গোর্খাল্যান্ড, সিকিম, ভুটান, মেঘালয়, বোড়োল্যান্ড, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরা, ইত্যাদি। এদের সবার মনোভাব ভয়ংকররকম স্বাধীনতাপ্রবণ। এমনকি ভারত দ্বারা ভূ-বেষ্টিত হিন্দু রাষ্ট্র নেপালও ব্যতিক্রম নয়। ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপ যেকোন কিছুর চেয়ে বাংলাদেশী জনগণের দুর্ভোগ অনেকগুণ বাড়িয়েছে। ফলে ‘এসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন স্টেটস অব সাউথ এশিয়া’ (এইএসএসএ ধারণা) সম্ভব, যা রাজনৈতিক না হলেও ৫০০ মিলিয়ন মানুষের একটি অর্থনৈতিক কনফেডারেশন গঠন করতে পারে। নয়াদিল্লীর রিমোট কন্ট্রোলে চালিত না হয়ে এসব ভৌগিলক ও অর্থনৈতিক ইউনিটগুলো কারো আধিপত্য ছাড়াই একটি কমন মার্কেট গঠন করতে পারে। সেখানে বাংলাদেশ হবে এই অঞ্চলের প্রভাবশালী অর্থনীতি ও সার্বভৌম সত্তা।

গত জুলাইয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, যা উৎসাহব্যঞ্জক সূচনা। এরপর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। তাদের বৈঠক আন্তরিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় এবং উভয় পক্ষ তাদের বর্তমান ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করতে একমত হয়। ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়ন তৈরি হয়েছে। চীন-ভারত সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠায় ভারতের সঙ্গে পানি নিয়ে লড়াই করার বদলে চীনের বিআরআই বিনিয়োগ বেছে নেয়াকে ভালো মনে করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অহমিকাপূর্ণ। পাকিস্তানের এখানে কোনভাবেই নাক গলানো উচিত নয়। আবার পাকিস্তান-বাংলাদেশের সম্পর্কটি ভারতের আত্মম্ভরিতার কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না।

কোভিড-উত্তর বিশ্ব আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদেরকে বৃত্তের বাইরে গিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে। ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে দুই দেশের জন্যই নতুন করে সূচনার পথ তৈরি হয়েছে। আমাদের দুই দেশের মধ্যে একটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

 

(লেখক, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক)