আমরা লাইভে English মঙ্গলবার, জুন ০৬, ২০২৩

জেনারেল ওয়াহিদ কাকার: সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের আদর্শ মডেল

COLUMN-ENG-21-04-2020
জেনারেল ওয়াহিদ কাকার

আবদুল ওয়াহিদ খান জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৭ সালের ২৩ মার্চ পেশোয়ারের উপকণ্ঠে কাকার গোত্রে (এই গোত্র বেলুচিস্তানের ঝব থেকে অভিবাসন করেছিল)। তার পূর্বপুরুষদের একজন হলেন সর্দার আবদুর রব নিশতার। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পরে পাঞ্জাবের গভর্নর ও আরো পরে পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল) সভাপতি হয়েছিলেন।

১৯৫৫ সালে স্থানীয় হাই স্কুল থেকে পাস করার পর তিনি এডওয়ার্ডস কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে কাকুলে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে যোগ দেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের (এসএফএফ) ৫ম ব্যাটালিয়নে কমিশনপ্রাপ্ত হন।

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী জেনারেল ওয়াহিদ কাকার নীতির ব্যাপারে ছিলেন অবিচল। সিওএএস হিসেবে পদোন্নতির আগে পর্যন্ত তিনি তার ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি সততার সাক্ষর রেখে গেছেন।

একটি উদারহণ হলো ১৯৮৭-৮৯ সালে তার সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট-জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়কার ঘটনা। প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের সরাসরি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়া তিন ছাত্রকে আর্মি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানান। কাকার মেধার ওপর পুরোপুরি বিশ্বাসী ছিলেন।

ত্রিশ বছরের বেশি সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাজ করার পর তিনি লে. জেনারেল হন, তাকে কোয়েটায় কোর কমান্ডার করা হয়। ১৯৯৩ সালে তিনি যখন অবসরগ্রহণের দ্বারপ্রান্তে, তখন হঠাৎ করে ওই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ নওয়াজ জানজুয়া (তিনিও ছিলেন দুর্দান্ত অফিসার) মৃত্যুবরণ করেন। ফলে ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সাথে পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান তাকে চার তারকা জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে কাকারকে সেনাপ্রধান করেন।

সেনাপ্রধান হিসেবেও তিনি পেশাগত মানের ওপর জোর দেয়া অব্যাহত রাখেন। সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলার সাথে মানানসই না হওয়ায় তিনি দুজন লে. জেনারেলকে (একজন ডিজি আইএসআইয়ের দায়িত্বেও ছিলেন) অবসরে পাঠিয়ে দেন।

নওয়াজ শরিফ ১৯৯০-এর দশকে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ক্ষমতা সুসংহত করা মাত্র প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা, জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেয়ার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাতিল করার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগ ভণ্ডুল করতে আগাম ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে জুলাই মাসে নতুন নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে নওয়াজ শরিফ পুনর্বহাল হন। এরপর কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দূরত্ব বজায় রেখে চললে রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের মুখে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। পাঞ্জাব জাতীয় পরিষদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে তাদের চেষ্টার ফলে পাঞ্জাব পুলিশ ও র‌্যাঞ্জার্সের মধ্যে সশস্ত্র সঙ্ঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।

জেনারেল কাকার ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে সাংবিধানিক সঙ্কট নিরসনে সিদ্ধান্তসূচক ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি ‘অপরিহার্যতার নিয়ম’ অনুসরণ করে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

তবে সংবিধানের আওতায় থাকার জন্য তিনি সিনেটের চেয়ারম্যান ওয়াসিম সাজ্জাদকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট করেন এবং মইন কোরেশিকে প্রধানমন্ত্রী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তদারকি করার জন্য।

তবে ওয়াহিদ কাকার ফরমুলার সাথে ২০০৭ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে প্রয়োগ করা ধারণার একটি পার্থক্য আছে।

তিনি ৯০ দিনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলেছিলেন। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ আমার পরামর্শ অনুসরণ করে প্রথম বছরে সফলভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন পরিচালনা করেন। তারপর তিনি এই কমিশনের দায়িত্ব দেন সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ জেনারেলকে। ফলে বাংলাদেশ মডেলের প্রথম বছরের দারুণ সাফল্য কেলেঙ্কারিতে চাপা পড়ে যায়। 

নিরপেক্ষ সরকারের টাচস্টোন অবশ্যই হতে হবে জবাবদিহিতা। তা ছিল বলেই ১৯৯৩ সালে ২৭ বছর আগে জেনারেল ওয়াহিদের অর্জন এখনো অমলিন।

পাকিস্তানের একজন লোকও জেনারেল ওয়াহিদ কাকারের কার্যক্রমকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেনি। ওই সময় কোনো সামরিক শাসন জারি করা হয়নি, কাকার সংবিধানের আওতাতেই কাজ করেছিলেন।

জেনারেল ওয়াহিদ কাকারের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বেলুচিস্তানের এক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ বলেছিলেন, এ ধরনের আলোকিত ব্যক্তিত্বকে আমি শ্রদ্ধা করি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে তিনি পেশাদারিত্বের সাথেই কাজ করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা, তিনি রাজনীতি বোঝার মতো বুদ্ধিমান ছিলেন এবং গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চালু করেছিলেন।

২০১০ সালের আগে খুব বেশি জেনারেল অফিসারের ১৯৬৫ বা ১৯৭১ সালের যুদ্ধ বা বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ দমনের অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে আজ সেনাবাহিনীর পুরো সিনিয়র অংশই নানা বিদ্রোহে অংশ নিয়ে অভিজ্ঞ হয়েছেন। আর ওয়াহিদ কাকার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে সিয়ালকোটে রাইফেল কোম্পানির সদস্য হিসেবে ও ১৯৭১ সালে সোলেমানকি সেক্টরে অংশ নেন। 

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ের পর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো সেনাপ্র্রধানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, তার উপদেশ কামনা করতেন নিয়মিত।

১৯৯৫ সালে জেনারেল আবদুল ওয়াহিদ কাকার আবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এবার আইএসআই ও এমআইয়ের সহযোগিতায় তাকে ও বেনজির ভুট্টোকে হত্যার একটি চেষ্টা ভণ্ডুল করে দেন।

১৯৯৬ সালে তার মেয়াদ শেষ হলে তাকে আরো তিন বছরের জন্য দায়িত্বে থেকে যেতে বলা হয়। প্রেসিডেন্ট লেঘারি ও বেনজির উভয়েই তাকে অনুরোধ করেন। এমনকি সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও তাকে থেকে যেতে বলেছিলেন। অবশ্য, তার দুই সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী তাকে বর্ধিত মেয়াদে না থাকতে পরামর্শ দেন।

অবসর গ্রহণের পর তাকে খুব কমই প্রকাশ্যে দেখা যেত। তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে একেবারে নিভৃত জীবনযাপন করতেন। তারপরও তিনি কোথাও গেলে তাকে দেখার জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যেত।

মেধা ও সততা দিয়ে কাজ করলে সুফল পাওয়া যায়, এটিই প্রমাণ করেছেন ওয়াহিদ কাকার। দায়িত্ব পালনের সময় ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ বা স্বজনপ্রীতি অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে।

জেনারেল ওয়াহিদ কাকার যে নৈতিক মূল্যবোধ প্রদর্শন করেছেন, তা বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব সেনা সদস্য ও আমলাদের অনুসরণ করা প্রয়োজন। যেকোনো দেশেই সরকার পরিচালনা করা বেসামরিক দায়িত্ব এবং দেশ যখন বিপদে পড়ে, কেবলমাত্র তখনই তাতে সাড়া দিয়ে সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার নামই ‘ওয়াহিদ কাকার মডেল।’

যারা ইউনিফর্ম পরেন, তাদের গর্বের কারণ হলো এই যে এই অত্যন্ত দক্ষ সৈনিক সারা জীবনে নিখুঁতভাবে তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

 

লেখক: প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক