ইসলামফোবিয়া মোকাবেলার সর্বোত্তম উপায় হলো সংলাপ

শুক্রবার বিকেলে উত্তর-পশ্চিম প্যারিসের নির্জন উপকণ্ঠে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক হামলাকারী, পরে জানা যায় যে তিনি ১৮ বছর বয়স্ক চেচেন এবং উদ্বাস্তু হিসেবে ফ্রান্সে এসেছিলেন, একটি স্কুলের হিস্টরি ও সিভিকসের শিক্ষককে কোণঠাসা করে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হামলাকারী আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়েছিলেন। এর সামান্য পরে টুইটারে এক পোস্টে তিনি বলেছিলেন যে আমি নবী মোহাম্মদকে অপমান করতে সাহসী কুত্তাগুলোর একটিকে হত্যা করেছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ তাকে খুঁজে গুলি করে হত্যা করে।
মুসলিমদের জন্য ইসলামের নবী (সা)-এর যেকোনো ধরনের ছবি আঁকা ভ্রষ্টাচার বিবেচিত হয়। তাঁকে নিয়ে মজা করার বিষয়টি অনেক পরের কথা। আসল রহস্য হলো, একটি স্কুলের হিস্টরি ও সিভিকসের শিক্ষক (ফ্রান্সের মতো সভ্য ও আলোকপ্রাপ্ত দেশে জ্ঞানী হবেন বলেই ধরে নেয়া যায়) কিভাবে বুঝলেন যে ইসলাম ও এর শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে মজা করলে সমস্যা হবে না? ইতিহাস বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তিটির ভয়াবহ পরিণামের বিষয়টি জানার কথা। শিক্ষিত ও সভ্য ইউরোপিয়ানরা কিভাবে এমনটা মনে করতে পারল? কাজটি কিন্তু তারা দশকের পর দশক ধরে করছে। ১৯৮৮ সালে সালমান রুশদির স্যাটার্নিক ভার্সেস দিয়ে এমন কাজের সূচনা।
অবশ্য ইসলাম ও ইসলামি ব্যক্তিত্বদের কলুষিত করার সমস্যাটি গত মাত্র ৩০ বছর ধরে নয়, বরং আরো আগে থেকেই বিদ্যমান। আর তা করা হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে। যেকোনো মূর্খ লোকেরই সাংবিধানিক অধিকার আছে তার অজ্ঞ মনে যা আসে, তাই চিৎকার করে বলার। ইউরোপে যেকোনো লোক খ্রিস্টকে নিয়ে, মেরিকে নিয়ে, এমনকি স্রষ্টাকে নিয়ে মজা করতে পারে। কারণ সেক্যুলার সমাজে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে এবং তারা তাদের অস্বীকার করতে পারে বলে তাদের নিয়ে মজা করাটা কাউকে কষ্ট দেয় না। এই প্রেক্ষাপটেই ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেক্কা হাভিস্টো বলেছেন, আমি কোনো কিছুই বুঝতে পারছি না: আমরা যখন কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে মজা করি, তখন তাকে বলা হয় বর্ণবাদ, যখন ইহুদিদের বিদ্রুপ করি, তখন বলা হয় সেমিটিকবিরোধী, যখন নারীদের নিয়ে মজা করি, তখন বলা হয় নারীবিদ্বেষী, আর যখন মুসলিমদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ করি, তখন তাকে বলা হয় কথা বলার স্বাধীনতা।
সারা দুনিয়ার মুসলিমরা কষ্ট পেয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্সের প্রায় ৬০ লাখ মুসলিমও রয়েছে। এমন আশঙ্কাও আছে যে চরমপন্থী ধর্মবেত্তারা যখন তরুণদের বিশ্বাস করাবেন যে তারা যদি কোনো ব্ল্যাসফেমারকে হত্যা করে, তবে সে সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে। অন্যদিকে ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামবিরোধী বার্তা আরো বেশি প্রচার করার সুযোগ পাবে। গির্ট উইডার্স, শার্লি এবদো ও এ ধরনের পত্রিকাগুলো সুযোগটি মিস করবে না।
কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না যে শিরশ্ছেদ বা অন্য কোনো ধরনের সহিংসতা এর সঠিক জবাব হতে পারে। সঠিক জবাব হতে পারে ইসলাম সম্পর্কে ইউরোপিয়ানদের ভয়ের আসল কারণটি প্রদর্শন করা।
কিন্তু ইউরোপ কি তার নিজের ছায়ার মুখোমখি হতে প্রস্তুত? ইসলাম সম্পর্কে ভীতি বা ইসলামফোবিয়া ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের অনেক দিনের রোগ। ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে ইউরোপের বিরূপ ধারণা ক্রুসেডের আমল থেকে। আর ইসলামে মুসলিম শাসন পর্যন্ত ইসলাম ছিল ফ্রান্সের দোড়গোড়ায়। পরবর্তী সময়ে ১৪তম ও ১৬তম শতক পর্যন্ত উসমানিয়া শাসন ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে হুমকির মুখে রেখেছিলো।
মুসলিম স্রোত রুখতে জার্মানির মার্টিন লুথারের মতো চার্চ সংস্কারকেরা ক্রুসেডারদের যুক্তিই গ্রহণ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, মুসলিমরা হলো অসভ্য বর্বর, ইসলাম শিক্ষা দেয় হত্যা করতে, নারীদের প্রতি নৃশংস হতে। খ্রিস্টানরা যাতে চার্চের প্রভাববলয়ের মধ্যেই থাকে, সেজন্য তিনি তাদের মধ্যে ইসলামের ভীতি সৃষ্টি করেন।

গণতন্ত্র ও মুক্তি সম্পর্কে ইউরোপিয়ান ধারণা, সস্তা প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইউরোপিয়ান পণ্যের বাজার হিসেবে উপনিবেশের কার্যকারিতা প্রবলভাবে প্রমাণ করেছিল ব্রিটিশরা। ১৮৫৮ সালে সনদ বাতিল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত জন স্টুয়ার্ট মিল সারা জীবন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ সমর্থন করেছিলেন। তার অভিমত ছিল, উপনিবেশিক জনসাধারণ অসভ্য। কাজেই তারা নিজেরা নিজেদের শাসন চালাতে সক্ষম নয়। ফলে তাদের শাসনের জন্য ইউরোপিয়ানদের দরকার। তিনি ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তার মুক্তবিষয়ক প্রবন্ধে এসব কথা বলেন। এই ধারণাটি মুসলিমদের এবং সেইসাথে তাদের উপনিবেশিক শাসনে থাকাদের বেলায় প্রযোজ্য। অনেকেরই মনে থাকতে পারে যে ব্রিটিশ ভারতের ব্রিটিশ ক্লাবগুলোর বাইরে ঘোষণা থাকত যে ‘ভারতীয় ও কুকুর প্রবেশ নিষেধ।’
উপনিবেশবাদের আরেক অবয়ব বিশ্বায়ন। এর জের ধরে লাখ লাখ মুসলিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে যায় চাকরি ও উদ্বাস্তু হিসেবে। ওই সময় ইউরোপ ও পাশ্চাত্য এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা আজকের ইসলাম ও মুসলিমদের সমস্যা কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে, তা জানে না। ফ্রান্স হলো এর একটি উদাহরণ।
তাহলে আমরা এই সমস্যার সমাধান করব কিভাবে? মনে রাখতে হবে, সহিংসতায় কোনো সমস্যার সমাধান করে না, বরং সহিংসতায় আরো বেশি সহিংসতার সৃষ্টি করে। এ কারণেই অন্য কোনো পথ খুঁজে নিতে হবে। আর তা অবশ্যই হতে হবে শান্তির পথ। পাকিস্তান পার্লামেন্ট ফরাসি পণ্য বয়কটের প্রস্তাব পাস করেছে। কিন্তু ফরাসি পণ্য বয়কট কোনো ভালো আইডিয়া নয়। বয়কট ও অবরোধ কখনো কাজ করে না। কয়েক বছর আগে ড্যানিশ বয়কটে কী হয়েছিল? ড্যানিশ ঘি-মাখন ঠিকই বাজারে পাওয়া যায় এবং তারা তাদের ক্রেতাদের ঠিকই খুঁজে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা কোন কোন ফরাসি পণ্য ব্যবহার করি? সম্ভবত আমাদের সশস্ত্র বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সাবমেরিন এড়াতে পারবে। এটা সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়বে কি?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বুধবার মুসলিম রাষ্ট্রনেতাদের কাছে চিঠি লিখে ইসলামফোবিয়া মোকাবেলায় অভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছেন। এতে কাজ হতে পারে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে। মুসলিম সংহতি বেশ বিপর্যয়কর অবস্থায় রয়েছে। মুসলিমবিদ্বেষ বিদ্যমান রয়েছে কয়েক শ’ বছর ধরে। এটি খুব সহজে মিটবে না।
স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সঙ্ঘাতের ভিত্তি হচ্ছে এই তত্ত্ব যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচিতিই স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সঙ্ঘাতের মূল উৎস। আর যুদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে নয়, বরং স্নায়ু-যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে হবে। তার এই ধারণাটি জার্মান ইতিহাসবিদ ওসওয়াইল্ড স্পেনগালারের তত্ত্বের অনুসরণ।
ফ্রান্সে যা ঘটছে, তা ভুল। শিরশ্ছেদ নৃশংস ব্যাপার। এমন পরিস্থিতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্টও যে ভূমিকায় রয়েছেন, তাও আবেগপ্রসূত। যাই হোক, আমাদেরকে ফ্রান্স ও ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে হবে, আবেগকে উৎরে যেতে হবে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ফ্রান্স কিন্তু পাকিস্তানের ওপর কঠোর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। অথচ তারা তা করতে পারত আনায়াসেই। আমরা অবশ্যই সব ধরনের ব্ল্যাসফেমির বিরোধিতা করব, বিশেষ করে আমাদের নবী সা:-কে লক্ষ্য করে করা বিদ্বেষ। তবে আমাদের অবশ্যই সঙ্ঘাত এড়াতে হবে। বয়কটের রাজনীতি নয়, বরং সংলাপের রাজনীতিই সমাধান।
লেখক: প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক