মিয়ানমারকে জানতে ‘মিস বার্মা’ এবং উদার মানসিকতা

চারমিন ক্রেইগের মিস বার্মা (২০১৭) একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রেঙ্গুনে বসবাসরত একটি কারেন পরিবারকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। বইটিতে বার্মার ২০ শতকের মধ্যভাগে হওয়া যুদ্ধগুলো কারেন দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। শুরু হয়েছে ১৯৪২ সালের জাপানের অভিযান দিয়ে, এবং এখনো চলতে থাকা যুদ্ধগুলোও এতে স্থান পেয়েছে। ১৯৪০-এর দশকে উদার গণতন্ত্রের নামে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার কথা বলে যেসব বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে, সেগুলোও এতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বইটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ২০১৫-পরবর্তী শান্তির যে কথা বলা হচ্ছে, তা ইয়াঙ্গুনে নতুন কিছু নয়। এই সঙ্ঘাতে বিভিন্ন সামরিক বাহিনী জড়িত। আর শান্তি আলোচকদের ব্যর্থতা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই।
মিস বার্মায় ব্রিটেন, জাপানি হানাদার ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সিআইএ এজেন্টদের ফায়দা হাসিলের প্রয়াসের মধ্যেই সহিংসতা ও শান্তি আলোচনা চলার কথা বলা হয়েছে। আর সবকিছুর নেপথ্যে বার্মার লৌহমানব নে উইনের ইনসেন কারাগারের নৃশংস জিজ্ঞাসাবাদকারী, সামরিক কমান্ডার, রেঙ্গুনের অভিজাত জীবনের সুবিধাভোগী ও শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী নৃশংস স্বৈরশাসকে পরিণত হওয়ার ছবি এতে স্থান পেয়েছে।
এসব প্রেক্ষাপটেই উপন্যাসে কারারুদ্ধ হওয়া, পলায়ন, শান্তি আলোচনা, শান্তিচুক্তির কথা এসেছে। এখানে যেকোনো মুহূর্তে তাদের গুলি করে লাশটি ভারী কিছুর সাথে বেঁধে হেলিকপ্টারে করে সাগরে ফেলা হবে- এমন ধারণা নিয়েই সবাই তাদের কাজে নিয়োজিত থাকে। উদার গণতন্ত্রকে কারেন ও বর্মি নেতাদের গ্রহণের প্রতিশ্রুতি এসেছে নির্যাতন, অভিজাত সমাজ, ইনসেন কারাগার, মিস বার্মা জঁমকালো প্রদর্শনী, মুভি তারকাখ্যাতি, প্রত্যন্ত কারেন কমান্ড পোস্টে নির্বাসনের মধ্য দিয়ে।
আর সাধারণভাবে বলা যায়, মিস বার্মা হলো রেঙ্গুনের একটি প্রখ্যাত কারেন পরিবারের সহজ-সরল গল্প। পরিবারটির যাত্রা শুরু হয় রেঙ্গুনের ইহুদি স বেনসনের সাথে কারেন বধূ ন খিনের বিয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৪১ সালে লুইসা বেনসন নামে এক মেয়ের জন্ম হয়। লুইসা ১৯৫৬ সালে মিস বার্মা সুন্দরী প্রতিযোগিতা জয় করে। ১৯৬০-এর দশকে তিনি কারেন বিদ্রোহী নেতা স লিন হতিনকে বিয়ে করেন।

মিস বার্মার সত্যিকারের শুরু ১৯৩৮ সালে রেঙ্গুন রোমাঞ্চ ও লুইসার মা-বাবার বিয়ের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানপন্থী বাহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পরিবারটি গ্রাম এলাকায় পালিয়ে যায়। সেখানে সহানুভূতিশীল কারেন গ্রামবাসীরা তাদের রক্ষা করে এবং এমনকি জাপানি সৈন্যদের নির্যাতন থেকেও তাকে বাঁচিয়ে দেয়। যুদ্ধের পর কারেন পরিবারটি ব্যবসা করে বেশ স্বচ্ছল হয়ে ওঠে। তারা রেঙ্গুনের এলিট কারেন মহলে সুপরিচিত হয়ে পড়ে। একইসাথে কারেনিস্তান নামে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেখানেও তারা বিশ্বাসঘাকতার শিকার হয়।
এর ফলে ১৯৪৯-১৯৫০-এর গৃহযুদ্ধে বার্মা ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়, বার্মিস কমিউনিস্ট পার্টি উত্তরাঞ্চল দখল করে, মুজাহিদিনেরা আরাকান দখল করে, কারেনরা মান্দালয় করায়ত্ত করে ইনসেনের দক্ষিণে এসে পরে। প্রধানমন্ত্রী উ নু ও সেনা কমান্ডার নে উইনের নেতৃত্বে বর্মি বাহিনী ইনসেনের যুদ্ধে জয়ী হয়। এই ঘটনা এখনো বর্মি ও কারেন-সবার স্মৃতিতে দাগ কেটে আছে (অবশ্য, ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে তা নেই)। পরিণতিতে স বেনসন ইনসিন কারাগারে বন্দী হন।
কাহিনীর ধারাবাহিকতায় পাঠকেরা স্বাধীনতা-পরবর্তী রেঙ্গুনের অভিজাত সমাজ এবং সেইসাথে বিশ্বাসঘাতকতা, মৃত্যু ও সদা-উপস্থিত কারা কর্মকর্তা জেনারেল নে উইনের সাক্ষাত পায়। আবার ব্রিটিশদের মতো আমেরিকানেরাও উভয় পক্ষে কাজ করে। উইলিয়াম ইয়ং (ছদ্মনাম হাটচেট) যেখানে কারেন বিদ্রোহীদের নানা লজিস্টিক সহায়তা দেন, তখন রাষ্ট্রদূত ইউলিয়ম সে বোল্ড কারেন বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে বর্মি সরকারকে দেন অস্ত্র।
মা-বাবা অপহৃত, নির্যাতিত ও কারারুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও লুইসা প্রথম মিস বার্মা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং ১৯৫৬ সালে ১৫ বছর বয়সী হিসেবে এবং ১৯৫৮ সালে ১৭ বছর বয়সী হিসেবে তাতে জয়ী হন। এলিট রেঙ্গুনের ছোট্ট অজাচার দুনিয়ায় তিনি ‘মূর্খতাপূর্ণ’ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেন। তিনি হন নে উইনের প্রিয়পাত্রী। এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি এই স্বৈরশাসকের রক্ষিতা হয়ে পড়েছেন।
লুইসার মুভি ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ খ্যাতির সময় ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন অভ্যুত্থান ঘটান। এরপর লুইসাকে প্রচারণামূলক ছবিতে কাজ করতে বলা হয়। এই কাজ করতে গিয়েই অভাবনীয়ভাবে তিনি কারেন ন্যাশনাল আর্মির জেনারেল নাইনতুনের প্রেমে পড়ে যান। এই আর্মিকে সিআইএ পৃষ্ঠপোষকতা করত। এই প্রক্রিয়াতেই পাশ্চাত্য সরকারগুলো জেনারেল নাইনতুনকে ১৯৬২-৬৩ সময়কালে প্রধানমন্ত্রী নে উইনের সাথে রেঙ্গুনভিত্তিক শান্তিপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে বলে। করেন সামরিক নেতাদের জন্য এটি ছিল বিপজ্জনক খেলা। কারণ আলোচনার জন্য তাদেরকে শত্রু এলাকার গভীরে যেতে হতো।
লুইসা ও জেনারেল নাইনতুন ১৯৬৪ সালে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। পরে নে উইনের আলোচকদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন নাইনতুন। তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। তার লাশ হেলিকপ্টারে করে সাগরে ফেলা হয়। লুইসা কারেনে ফিরে গিয়ে তার স্বামীর বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সাময়িক সময়ের জন্য। এখানে তিনি অন্যান্য কারেন গ্রুপের সাথে আলোচনা করেন। কিন্তু একপর্যায়ে তার বাহিনী তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তিনি তার বাবার সাথে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এই ব্যবস্থা করে দেয় সিআইএ। আর এভাবেই উপন্যাসটির অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স শেষ হয়।
তবে কাহিনীর শেষ এখানেই নয়। লেখক চারমিন ক্রেইগ মিস বার্মা প্রকাশের পর যেসব সাক্ষাতকার দিয়েছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, সেগুলোর কথা জানতে পারি। লুইসা আমেরিকায় বিয়ের প্রস্তাব পান এবং মিস বার্মার লেখকের মা হন।
বার্মায় আসলে কী হচ্ছে? আমেরিকান, ব্রিটিশ ও অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তি তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই মিয়ানমারে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। মিস বার্মার বার্তা হলো এই যে যুদ্ধবিরতি, শান্তি আলোচনা আর পাশ্চাত্যের প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো স্রেফ কথার কথা। এগুলোতে যে একমাত্র ফল পাওয়া যাবে তা হলো এবার নতুন করে এসবের শুরু। আর এতে যে ক্ষতি হয়, তা পোহাতে হয় যাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়, তাদেরই।