পর্তুগিজ যুগেরও আগে আরবদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার শান্তিপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক
.jpg)
এই গ্রন্থ পর্যালোচনায় প্রাচীন শ্রীলঙ্কা ও আরববিশ্বের মধ্যকার সম্পর্ক পরীক্ষা করা হবে। ‘আরবস অব সেরানদিপ’ নামের বইটি লিখেছেন ড. রহিথা দাসানায়াকা। তিনি শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডির পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক।
২০১৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটি ২০১৯ সালে সেরা ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে শ্রীলঙ্কা স্টেট লাইব্রেরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। এখানে আরববিশ্ব ও শ্রীলঙ্কার (মুসাফিরদের, বিশেষ করে আরব মুসাফিরদের কাছে ভাষায় সেরানদিপ) মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেশটি সাহেলান (বা জেলিান), তাপ্রোবেন বা জাজিরারুল বা পদ্মরাগমণির দ্বীপ নামেও পরিচিত ছিল।
বইটিতে ইসলাম-পূর্ব ও ইসলাম-পরবর্তী আরববিশ্বের সাথে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। আলোকপাত করা হয়েছে ইসলামের আগমনের আগে শ্রীলঙ্কার প্রাচীন বৌদ্ধ রাজাদের সাথে আরবদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ওপর।
দাসানায়াকা বলেন, সেরানদিপ ও আশপাশের লোকজন যখন ইসলামের নবীর আগমন ও তার বাণীর খবর পেল, তখন তারা তাদের মধ্য থেকে একজন জ্ঞানী লোককে আরবে পাঠিয়েছিল নবী সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা পেতে।
ওই ব্যক্তি দীর্ঘ জটিল সফর করে মদিনায় যখন পৌঁছালেন, তত দিন নবী মোহাম্মদ (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) এবং এমনকি তার উত্তরসূরী আবু বকর (৬৩২—৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত ইন্তেকাল করেছিলেন, উমরের শাসনকাল (৬৩৫-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) চলছে।
ওই লোক খলিফার সাথে সাক্ষাত করে তার কাছ থেকে নবীর মিশন ও তার চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। সফর শেষে ফেরার পথে মাকরান উপকূলে (পশ্চিম পাকিস্তানে) তিনি পরলোকগমন করেন। তবে তার সাথে থাকা তার চাকর সেরেনদিপে ফিরে এসে আরবে যা দেখেছেন ও নবী সম্পর্কে যা শুনেছেন তা মুগ্ধকরভাবে উপস্থাপন করেন।
ইসলাম-পরবর্তী আরব-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক নিয়ে প্রাচীনতম ভাষ্যটি দিয়েছেন ইরানি নাবিক ইবনে শাহরিয়ার (৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি তার গ্রন্থ ‘আজাইব আল হিন্দি’ বা ‘ভারতের আশ্চর্য বিষয়াদি’-এ শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন।
ইবনে শাহরিয়ার লিখেছেন, সেরানদিপ ও আশপাশের লোকজন যখন ইসলামের নবীর আগমন ও তার বাণী সম্পর্কে জানতে পারল, তখন তারা তাদের মধ্য থেকে একজন জ্ঞানী লোককে আরবে পাঠাল তার সাথে সাক্ষাত করে তার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ করে দেশের লোকজনকে জানানো।
ড. রহিথা দাসানায়াকা
ইসলাম সম্পর্কে ভারতীয় চাকরের কাছ থেকে ইতিবাচক ভাষ্য জানতে পেরে ওই সময়ের লঙ্কানরা ইসলাম গ্রহণকারী পারস্য ও আরব অঞ্চলের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে উৎসাহিত হয়। দাসানায়াকের গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে লঙ্কা ও আরবের মধ্যে বন্ধুত্বের গভীরতা ও উপহার বিনিময়ের বিষয়গুলো। সিংহলি রাজারা মুক্তা ও অন্যান্য দুর্লভ উপহার পাঠান জাহাজে করে এবং তারাও দুর্লভ উপহার গ্রহণ করেন।
অষ্টম শতকে শ্রীলঙ্কাকে জাহাজ নির্মাণ জাতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, আরব শাসকদেরকে উপহার হিসেবে জাহাজও দেয়া হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা ছিল জাহাজ নির্মাণের উপকরণ (বিশেষ করে জাক বৃক্ষের কাঠ) সংগ্রহের জন্য আরবদের জনপ্রিয় গন্তব্য।
শ্রীলঙ্কার হাতি, মুক্তা, রুপা, স্বর্ণ ও নানা দুর্লভ পণ্যের জন্যই পারস্য ও আরবদের কাছে প্রিয় ছিল শ্রীলঙ্কা। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে পাশ্চাত্য ও চীনের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য ছিল। এখানে বাণিজ্যের জন্য পারস্য উপসাগর ও আরব উপদ্বীপের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল।
সাগরে প্রাচীন আরবদের দক্ষতা প্রসঙ্গে বলা যায়, তারা ফনেশিয়াদের (দক্ষিণ আরবের হাজরা মাওতে ছিল তাদের রাজত্ব) নটিক্যাল জ্ঞান ও বাণিজ্য অভিজ্ঞতার উত্তরসূরী ছিল।
‘আরবস অব সেরানদিপ’ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, সপ্তম শতকে কোরেশ গোত্রের নবী মোহাম্মদের সাগর বিচরণে আরবদের অভিজ্ঞতার বিষয়টি অবগত হয়েছিলেন। এটি ইসলামের আরবে সীমিত না থেকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে সহায়ক হয়েছিল।
ফারসি পাণ্ডুলিপি চাচনামায় উল্লেখ করা হয়েছে যে সেরানদিপের রাজা কয়েকজন সভাসদকে মুক্তা দ্বীপের উপহার নিয়ে সাগরপথে জাহাজ, নৌকা দিয়ে হেজাজে পাঠিয়েছিলেন। লঙ্কার রাজা খলিজার রাজধানীতে কয়েকজন আবেসিনিয়ান পুরুষ ও নারী ক্রীতদাসও পাঠিয়েছিলেন। বইটি ৭৫৩ সালের আগে লেখা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।
আরব ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্ভবত শুরু হয়েছিল ৬৮৪-৭১৮ সময়কালে লঙ্কান রাজা মানভাম্মার আমলে। বইটিতে সমসাময়িক ইসলামি আরবি সাহিত্যের উল্লেখে মনে হয়, এ সময় আরব বসতি ছিল।
ইরানি, আরব ও আবিসিনিয়ানরা ছাড়াও সপ্তম শতক থেকে ওমান, সিরাফ ও ইয়েমেন থেকে বণিকেরাও শ্রীলঙ্কায় বসতি স্থাপন করতে থাকে। দেশটিতে উমাইয়া খলিফা আল ওয়াহাদের (৭০৫ থেকে ৭১৫ সাল) আমলের কিছু মুদ্রাও পাওয়া গেছে।
এছাড়া ইসলামি ধর্মপ্রচারক খালিদ বিন আবু বাকায়ার কবরে সমাধিফলক পাওয়া গেছে। শ্রীলঙ্কায় এটিই প্রথম আরবি সমাধিফলক।
শ্রীলঙ্কার বণিকদের অব্যাহত অনুরোধে ওই সময়ের বাগদাদের খলিফা আল মুকতাফি বিল্লাহ তাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি হিজরি ৩০০ বা ৯১২ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন শ্রীলঙ্কা। তিনি ১৭ বছর পর ইন্তেকাল করেন বলে জানা যায়।
এই খলিফা যখন পারস্য উপসাগর ও বসরা নিয়ন্ত্রণ করতেন, তখন তিনি সিলনে আরবি, গ্রিক ও রোমান ক্লাসিক্যাল বিজ্ঞান ও সাহিত্য প্রবর্তন করেছিলেন। ওই সময়ে ভূমধ্য সাগরজুড়ে ইসলামি শক্তি সম্প্রসারিত হচ্ছিল।
আইয়ুবি রাজবংশের সুলমান সালাহউদ্দিনের আমলে শ্রীলঙ্কা ও ইসলামিবিশ্বের মধ্যকার সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে যে ওই সময় উদ্দীপ্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ধর্ম তেমন গুরুত্ব পেত না। ইতিহাস লেখক আল ইদ্রিসি উল্লেখ করেছেন, বাণিজ্য বিষয়াদি নিয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য লঙ্কার রাজার সভাসদে চারজন বৌদ্ধ, চারজন খ্রিস্টান, চারজন মুসলিম ও চারজন ইহুদি ছিলেন।
এতে আরো বলা হয়েছে যে ত্রয়োদশ শতকের পর থেকে পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম বণিকেরা ধীরে ধীরে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করতে থাকেন। এতে উল্লেখ করা হয, পঞ্চদশ শতকে ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজরা প্রবেশ করার পর তাদের বিতাড়িত করার জন্য মুসলিম মধ্যস্ততাকারীদের মাধ্যমে কেরালার কালিকটের জামোরিনের (উভয়ের অভিন্ন শত্রু ছিল পর্তুগিজরা) সহায়তা কামনা করেছিলেন সিংহলের রাজারা।
উল্লেখ করা হয়েছে যে পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে ভারতবর্ষের উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে ভারতীয় মুসলিম বণিকদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির ফলে শ্রীলঙ্কায় মুসলিম বসতি দ্রুত বাড়তে থাকে। বইটিতে বলা হয়েছে, পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ফারনাও ডি কুয়েরোজ অভিযোগের সুরে বলেছেন যে মুসলিমরা শ্রীলঙ্কায় বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ করে আসছে। পর্তুগিজরা মুসলিম বণিকদের বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়েছিল। তারা তাদেরকে দমন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।
বইটিতে জোরালোভাবে বলা হয়েছে যে ইসলামের আবির্ভাবের আগে ও পরে শ্রীলঙ্কা ও আরবদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। নিরবচ্ছিন্ন এই সম্পর্ক ১৫তম শতকে পর্তুগিজদের আবির্ভাবে শেষ হয়ে যায়।
আরববিশ্বের সাথে শ্রীলঙ্কানদের দীর্ঘ ও শান্তিপূর্ণ ইতিহাসের এসব তথ্য আমরা এই বইটি থেকে পাই।